• ঢাকা
  • রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
গণভবনে ডাক

আশা-নিরাশার দোলাচলে ১৪ দলীয় জোট


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: মে ২১, ২০২৪, ০৯:৫৬ পিএম
আশা-নিরাশার দোলাচলে ১৪ দলীয় জোট
১৪ দলীয় জোটের লোগো। ফাইল ফটো

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মোটামুটি ভালো অবস্থানেই ছিল জোটের শরিকরা। একাদশ জাতীয় সংসদে ছয়টি আসন ছিল শরিক চার দলের। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে হোঁচট খেয়েছে জোটগত নির্বাচনী রাজনীতি। এরপর থেকেই আলোচনার ডালপালা মেলতে শুরু করে।

জোট সূত্রমতে, গত ৫ বছরে জোটের বৈঠক হয়েছে দেড় ডজনের মতো। যার সিংহভাগই হয়েছে জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর বাসায়। সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে কয়েকটি সমাবেশ হয় ১৪ দলের ব্যানারে। আর ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

জাতীয় নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গত ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর জোট নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর জোটগত কর্মসূচি দেখা যায়নি। সেভাবে কোনো বৈঠকেরও আয়োজন হয়নি। ফলে শরিকদের মধ্যে মান-অভিমান দেখা দেয়।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর সাড়ে চার মাস কেটে গেলেও অভিমান ভাঙানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন জোট শরিকরা। অনেকটা আশা-নিরাশায় দিন কাটছে তাদের। অনেকে আবার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম না থাকায় ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

শরিক নেতাদের মতে, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মোটামুটি ভালো অবস্থানেই ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা। একাদশ জাতীয় সংসদেও ছয়টি আসন ছিল শরিক চার দলের। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে হোঁচট খেয়েছে জোটগত নির্বাচনী রাজনীতি।

সূত্রমতে, দ্বাদশ নির্বাচনে জোটের শরিকদের ছয়টি আসন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থী দেয়নি সরকারি দল। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ছয়টি আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে বিজয়ী হয়েছেন জোট নেতারা। ‘ভাগ্য বিপর্যয়’ ঘটেছে শরিক দলের শীর্ষ ও হেভিওয়েট নেতাদেরও। পরাজিত হন হেভিওয়েট নেতা হাসানুল হক ইনু ও ফজলে হোসেন বাদশা। এতে হতাশা ভর করেছে জোট দলগুলোতে।

তবে এমন পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীন দলের কৌশলগত নির্বাচনী রাজনীতিকেই দায়ী করছে জোট শরিকরা। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে রেখে দেয়া, সর্বোপরি শরিক দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করাতেই ছিটকে পড়তে হয়েছে তাদের। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে চরম ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি থেকে জোটে শুরু হয় টানাপোড়েন।

এ অবস্থায় বৈঠক ডেকে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণের তাগিদ ছিল জোট শরিকদের। তাদের মতে, ১৪ দল নির্বাচনী জোট নয়; আদর্শিক জোট। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ২৩ দফার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ১৪ দলীয় জোট এক সঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠন নীতি নিয়ে প্রায় দুই দশক পথ চলছে। সেই চলার পথে বিভিন্ন সময় ভুলভ্রান্তি, ছন্দপতন, মান-অভিমান দেখা গেলেও জোট এখনও সময়ের দাবি।

জোট নেতাদের ভাষ্য, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আজও পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে ১৪ দলের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই।

জোট নেতাদের মান-অভিমান, ক্ষোভ আর শরিকদের রাজনৈতিক আদর্শদের অঙ্গীকারের গভীর উপলব্ধির মধ্যে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (২২ মে) সন্ধ্যা ৭টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

তবে ১৪ দলের বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে বিষয়ে কিছুই জানে না শরিক দলগুলো। বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু এবং সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ দলের উপদেষ্টা পরিষদ ও সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন নেতাও। জোটের প্রতিটি শরিক দলের দুইজন করে শীর্ষ নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার জোটের বেশ কয়েকজন নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

বৈঠক বিষয়ে শরিকরা বলছে, ১৪ দলের দীর্ঘদিনের পথচলা আরও দীর্ঘ হবে নাকি ছন্দপতন ঘটবে, এমন টানাপড়েনের মধ্যে জোটের বৈঠক ডাকায় নতুন করে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সব মান-অভিমান ভুলে অপশক্তির বিরুদ্ধে ফের ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থাকার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “বৈঠকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনব। তারপর সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার পর নিশ্চয়ই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মেমন বলেন, জোটনেত্রী শেখ হাসিনাই তো বলেছেন, ১৪ দল আছে, থাকবে। এখন দেখা যাক কী হয়।”

মেননের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, “১৪ দলের শরিক দলগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমাকে কল করে ২ জনের কথাই বলা হয়েছে।”

তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, “দীর্ঘদিন পর জোটের বৈঠক হচ্ছে, সেখানে নানা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তিনি যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই বৈঠক হবে। সে কারণে আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব নয়।”

এ বিষয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক (ইনু) বলেন, “যে আদর্শিক কারণে জোট হয়েছিল, তা এখনও প্রাসঙ্গিক। আমাদের লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। সরকার-রাষ্ট্র-সমাজে কিছু সমস্যা রয়েছে যা অনভিপ্রেত। শেখ হাসিনা জোটকে গতিশীল করার কথা বলেছেন। কীভাবে গতিশীল হবে, এটি চিন্তা করতে হবে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। সেটা নির্ভর করবে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর।”

এক প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক বলেন, “জাসদ কী ভাবছে সেটি বড় কথা নয়, শেখ হাসিনা জোট নিয়ে কী ভাবছেন, সেটিই বড় কথা। এক দিকে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে মোল্লাতন্ত্র, অন্যদিকে সরকারের ছত্রছায়া গুন্ডাতন্ত্র জনগণকে অস্বস্তিতে রেখেছে। এসব সমস্যা ভাবার পাশাপাশি স্বস্তির জায়গা তৈরি করা বড় চ্যালেঞ্জ।”

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, “আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের প্রধান নেত্রী। তিনি বৈঠকে কী বলেন, সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি থাকবে। বর্তমান অবস্থায় ১৪ দলের প্রয়োজন আদৌ আছে কি না, থাকলে জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে সেসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। দীর্ঘদিন পরে বৈঠক হচ্ছে, অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনা হতে পারে।”

এ বিষয়ে ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, “প্রধানমন্ত্রী জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। ইতোমধ্যে জোটের সকল নেতাকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। ১৪ দলের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবেন শেখ হাসিনা।”

প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ, ১১ দল, জাসদ ও ন্যাপকে নিয়ে ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতার পর থেকে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ১৪-১৬টি আসনে ছাড় দেয়া হয়।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে জয়ী হওয়ার পর ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত মহাজোট সরকারে ঠাঁই মিলেছিল শরিক নেতাদের। একাদশ এবং দ্বাদশ সংসদে সরকারে ঠাঁই হয়নি জোট শরিকদের। এই অবস্থায় জোটকে চাঙা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকেই তাকিয়ে আছেন জোট নেতারা।

Link copied!