রাজধানীর মগবাজারের নয়াটোলা এলাকার ১৫২/১ নম্বর বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই চোখে পরে বড় করে লেখা নগর মাতৃসদনের সাইনবোর্ড। ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় লম্বা লাইন। অপেক্ষমান কিছু মানুষ একজন একজন করে আগাচ্ছে আর নাম নিবন্ধন করছে। নিবন্ধনের পর সমস্যা অনুযায়ী প্রবেশ করছে নির্ধারিত কক্ষে। তাদের মধ্যে আছে শিশু থেকে কিশোর-কিশোরী ও গর্ভবতী মায়েরা। এদের একজনের নাম শারমিন। ১০ বছর বয়সী এক মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে কাঠালবাগান এলাকা থেকে মগবাজারের এই মাতৃসদনে এসেছেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরে মেয়ের শরীরে জ্বর, সেজন্যই আসা।
শারমিনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, “এখানে প্রায় দুইবছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। কয়েকদিন আগে এই হসপিটালেই আমার একটি বাচ্চা হয়েছে, তার বয়স এখন ২ মাস। এখন মেয়েটা অসুস্থ তাই তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসলাম। ডাক্তার দেখে প্রস্রাব আর রক্ত পরীক্ষা করেছে। পরীক্ষার খরচও কম।”
কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম এখানে আসা কেন? তিনি বলেন, “আমাদের বাসার আশেপাশেও তো হাসপাতাল আছে, কিন্তু এখানকার চিকিৎসা অনেক ভাল। ডাক্তাররা ভালভাবে ধীরে সুস্থে আমাদের কথা শুনে, ভাল ব্যবহার করে, সেজন্যেই এতো দূর থেকে এখানে আসি এবং আমার কথা শুনে কাঠালবাগানের আমার পরিচিত অনেকেই এখানে আসে চিকিৎসা নিতে।”
স্থানীয় সরকার বিভাগের আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলভারী প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এই নগর মাতৃসদন। ২০টি সাধারণ সজ্জা ও দুইটি কেবিন বিশিষ্ট এই মাতৃসদনে বহিঃর্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক রোগী আসে। অন্তর্বিভাগটি শুধু প্রসূতি মায়েদের জন্য। বহিঃর্বিভাগে ফিজিশিয়ান, শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়াও অন্তর্বিভাগে পালাক্রমে ৪ জন ডাক্তার নিয়মিত সেবা দিয়ে থাকেন।
এ মাতৃসদনে গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সেবা, মাসিক নিয়ন্ত্রণ সেবা, গর্ভপাত পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিসেবা, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ রোগের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, রোগ নিরূপণ সেবা ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া যায়।
৫০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এখানে যে কেউ নির্ধারিত সেবা নিতে পারেন। ৩০ শতাংশ লাল কার্ডধারী মানুষ একেবারেই বিনামূল্যে সেবা নিচ্ছেন। অন্যরা সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সেবা নিতে পারবেন। এমনকি গর্ভকালীন সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অন্যান্য আরো কিছু পরীক্ষা সরকারি খরচে এখানে রোগীরা করতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) মাতৃসদনের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় বহিঃর্বিভাগে রোগী দেখছেন ড.আরিফা আইয়ূব। এসময় তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি নতুন রোগী এবং পরবর্তী পর্যবেক্ষণের জন্য সহ শতাধিক রোগী আসে। আমরা গর্ভবতী মায়েদের শুরুর দিকে অর্থাৎ ৮ মাস পর্যন্ত, প্রসব পরবর্তী মায়েদেরসহ শিশু, কিশোর-কিশোরীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাছাড়াও প্রথমবার ঋতুবতী কিশোরীদের কাউন্সিলিং করে থাকি।”
“তবে গর্ভকালীন বয়স যাদের ৮ মাস অতিক্রম করে তাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভবনের দোতলায়। সেখানেও প্রতিদিন প্রায় ১০০ জন রোগী আসে।”
কথা হয় দ্বিতীয় তলায় কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ড. মনিরা আক্তার মুন্নির সাথে। তিনি বলেন, আমরা গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে অর্থাৎ ৮ মাস পরবর্তী সময়ের গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আমাদের আর যে ৪ টা কেন্দ্র আছে সেখানে গর্ভবতী মেয়েদের ৮ মাস পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকে। তারপর আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিলে ডেলিভারী পর্যন্ত আমরা এসব রোগীদের সেবা দেই।
হাসপাতালটির তিন তলায় সাধারণ ওয়ার্ড ও কেভিন। সিড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠতেই দেখা হয় সিজারের মাধ্যমে সদ্য জন্ম নেওয়া এক শিশুকে কোলে নিয়ে উঠছেন শিশুটির নানু। শিশুটির বাবা একটা গার্মেন্টসে কাজ করেন। শিশুটির মা পপি আক্তারের কাছে খরচ কেমন হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো লাল কার্ড পেয়েছি তাই আমার কোনো খরচ লাগেনি। এমনকি বেড ভাড়াও লাগেনি।
তার পাশের কেভিনেই দেখা যায়, অল্প বয়সী সদ্য মা হওয়া শিউলিকে (ছদ্মনাম)। গত ১০ বছর ধরে তিনি এবং তার পরিবার এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি যখন কিশোরী তখনও যেমন চিকিৎসা পেয়েছেন এখন এখানেই তিনি একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলেন। তিনি বলেন, “এখানকার চিকিৎসা খুব ভাল তাই প্রায় ১০ বছর ধরে আমার মা-বাবাসহ আমরা চিকিৎসা নিই। খরচও কম আবার ভাল চিকিৎসা, সেজন্যেই এখানে ডেলিভারী করেছি।”
এসময় ইনফরমেশন টেকনোলজি অফিসার মো.বদিউজ্জামান তালুকদার বলেন, “আমরা ৩০ শতাংশ রোগীকে লাল কার্ড দিয়ে থাকি। এই লাল কার্ড প্রদানের জন্য আমরা বাসায় বাসায় গিয়ে পরীক্ষা করি ও একটা ফর্ম পূরণ করি। এই ফর্মে যাদের স্কোর শূন্য থেকে ২০ তাদেরকে আমরা বলি অতিদরিদ্র, আবার যাদের স্কোর ২০ থেকে ৩০ তাদেরকে বলি দরিদ্র। এই শুন্য থেকে ৩০ স্কোরধারীদের আমরা লাল কার্ড দিয়ে থাকি।”
লাল কার্ড যারা পাবেন, তারা সম্পূর্ণ বিনা খরচে ও বাকিরা সরকারি খরচে এখানে নির্ধারিত সব সেবা যে কেউ পাবেন বলে উল্লেখ করেন আরবান প্রাইমারী হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারী প্রজেক্ট-২ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার ড. উসাং প্রু চৌধুরী। তিনি বলেন, “দুঃস্থ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষদের স্বল্প খরচে আমরা সেবা দিয়ে থাকি। এখানে আমরা ১২০০ টাকায় নরমাল ডেলিভারি, এবং ১২ হাজার টাকায় সিজারিয়ান ডেলিভারী দিয়ে থাকি। তাছাড়া বিভিন্ন আপদকালীন সময়েও অতিরিক্ত সেবা যেমন কোভিডের সময় টিকা দেওয়া থেকে শুরু করে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষাও করে থাকি।
২০০১ সাল থেকে আমাদের এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে যা এখনো ভালোভাবে চলমান। তিনি আরো বলেন, “আমরা সবসময় আমাদের স্টাফ ও ডাক্তারদের বলে থাকি রোগীর সাথে ভাল ব্যবহার করতে ও ভাল সেবা প্রদানের জন্য। সেভাবেই আমরা সরকারি খরচে সবাইকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।”