‘পুরোনো টাকা দিয়ে নতুন টাকা নিয়ে যান’, ‘ছেঁড়া-কাটা টাকা দিয়ে ভালো টাকা নিয়ে যান’। এভাবেই ডেকে ডেকে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে দেখা যায় গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটের সিঁড়ির সামনের ফুটপাতের ব্যবসায়ী মহসিন মিয়াকে। তীব্র রোদকে উপেক্ষা করে ছাতার নিচে বসে হেঁটে যাওয়া মানুষদের নতুন টাকা সংগ্রহ করতে অনুগ্রহ করছেন তিনি। ক্রেতারাও আসছেন দরকষাকষি করছেন, পুরোনো টাকা দিয়ে নতুন টাকা কিনে হাসিমুখে বাসায় ফিরছেন।
এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশকে মহসিন মিয়া জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে গুলিস্তানে নতুন টাকা বিক্রি করছেন তিনি। এ টাকা কেনাবেচা করেই চলছে তার সংসার। এ বছর ব্যাংক থেকে নতুন টাকা কম ছাড়ার কারণে তাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। সে কারণেই গত বছরের চেয়ে এ বছর নতুন টাকার দাম একটু বেশি।
গুলিস্তান ঘুরে দেখা যায়, টেবিলে নতুন টাকার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এখানে মহসিন মিয়ার মতো অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী টাকা কেনাবেচা করছেন। ২ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত সব ধরনের নোটের নতুন বান্ডেল পাওয়া যায় তাদের কাছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের আগ মুহূর্তে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার বেশি বিক্রি তাদের। পাঁচ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকার নোটের চাহিদা বেশি। এবার ২০ টাকার নোটের একটি বান্ডেল (এক হাজার টাকা) বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৫০ টাকায়। ১০ টাকার বান্ডেল (এক হাজার টাকা) বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা বেশি অর্থাৎ এক হাজার ৩০০ টাকা। পাঁচ টাকার নোট ১০০টি নিলে গুনতে হচ্ছে বাড়তি ১৫০ টাকা। এছাড়াও হাজারে ৫০ টাকা বেশি দিয়ে ১০০ টাকার নোটের বান্ডেল বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকার নোট এক বান্ডেল (এক হাজার টাকা) নিতে হলে বাড়তি দিতে হচ্ছে ১০০ টাকা। দুই টাকার নোট ৬০০ টাকার বান্ডেল বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়।
জামিরুল নামের এক ব্যবসায়ী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা নতুন টাকা কিনে আনি। যাদের কাছ থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করি, তারা গতবারের চেয়ে এবার প্রতি বান্ডিলে ২০-৩০ টাকা বেশি রাখছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে নতুন টাকা কম সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে তৃতীয় পক্ষ থেকে টাকা সংগ্রহ করায় দাম বেশি দিতে হয়েছে। নতুন টাকার চাহিদা অনেক। কিন্তু সেই অনুপাতে আমরা সংগ্রহ করতে পারেনি।”
জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাজারে নতুন টাকা ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩১ মার্চ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখা থেকে নতুন নোট সংগ্রহ করছেন গ্রাহকরা। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৮০টি শাখা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় নতুন টাকা বিনিময় করা হচ্ছে। তবে ব্যাংক থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ মানুষ।
তারা বলছেন, ব্যাংকে নতুন টাকা সংগ্রহ করতে গেলে বলা হয়, টাকা নেই অথবা শেষ। বিভিন্ন ব্যাংক ঘুরেও যেখানে নতুন টাকা পাওয়া যায় না, সেখানে গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের কাছে কীভাবে নতুন টাকা আসে।
নতুন টাকা কিনতে গুলিস্তানে আসেন রফিক মন্ডল। গত এক সপ্তাহ ধরে কোনো ব্যাংকে নতুন টাকার সংগ্রহ করতে না পারায় শেষ ভরসা গুলিস্তানের ফুটপাত। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে অন্তত ৪-৫টি ব্যাংকে ঘুরেছি নতুন টাকার জন্য। কিন্তু কোথাও টাকা পাইনি। বেশি টাকা দিয়ে টাকা কিনতে চেয়েও টাকা মেলেনি। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাড়া হয়েছে সেগুলো গেল কোথায়।”
ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিক মন্ডল বলেন, “দেশের বাজারে ব্যবসায়ীরা সব কিছুতে সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তারাও নতুন টাকার সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীদের মতো করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এখন আমরাও অসহায় নতুন টাকা সংগ্রহ করতে হবে। তাই অতি মাত্রায় সিন্ডিকেট হলেও আমাদের কিছু করার ছিল না, থাকবেও না।”
টাকা কিনতে আসা রহমত নামের আরেক ক্রেতা বলেন, “ভাগনে-ভাতিজি ও ছোট ভাইদের ঈদ সালামি দেবো, সে কারণে পাঁচ হাজার টাকা কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু গতবারের চেয়ে এবার দাম চড়া। এক বান্ডেল ১০ টাকার নোট (এক হাজার) কিনেছি, বাড়তি ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। সব দোকানে একই দাম। কোনো দামাদামিরও সুযোগ নেই।”
মজিবুর রহমান নামের আরেক ক্রেতা বলেন, “আগে টাকা কেনার জন্য গুলিস্তান আসা হয়নি। জালনোট আছে কি না সেই ভয়ও আছে। তবুও নাতি-নাতনি ও প্রতিবেশীদের জন্য নতুন টাকা সংগ্রহ করেছি। ১০ টাকা, ২০ টাকা ও ৫০ টাকার বান্ডেল কিনেছি।”