গত দেড় বছর ধরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রামে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথ চাঙ্গা রেখেছে আওয়ামী লীগ। তবে আসন্ন রমজানে দেশের তরুণদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ‘প্রাথমিক সদস্য’ অন্তর্ভুক্তকরণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সরকারি দলটি।
এই কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়নে দলের তৃণমূলের কর্মীদের চাঙ্গা রাখা। দেশের তরুণদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ‘প্রাথমিক সদস্য’ অন্তর্ভুক্তকরণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২২ মার্চ রাত থেকে সাহ্রি খাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাসজুড়েই জেলা-উপজেলা এবং নগর-মহানগর, থানা-ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচি শুরু করতে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে যেসব জেলায় সম্মেলন করা হয়েছে, সেগুলোতে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি জোটের সরকারবিরোধী কর্মসূচির বিপরীতে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া এবং তাতে লোক সমাগম বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, চলতি বছরের শেষ সপ্তাহ কিংবা আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রমজান মাসে ইফতার মাহফিল আয়োজন, নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান হাতে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে— এবারের জাতীয় নির্বাচনটি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হবে। এ জন্য প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ভেবে-চিন্তে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী শেখ হাসিনা। সাধারণ মানুষকে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে এবং কর্মসূচিগুলোতে সমাগম বাড়াতে বলেছেন তিনি। নির্বাচন সামনে রেখে রমজান মাসে রেকর্ডসংখ্যক নতুন সদস্য সংগ্রহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
গত ১৫ মার্চ বিকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত যৌথ সভায় বিষয়টি সবার নজরে আনেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওইদিন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভা ছিল। সেখানে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ অন্যান্য কর্মসূচি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করার কথা বলেন তিনি।
রমজানে সদস্য সংগ্রহের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, “রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মসূচি হিসেবে সদস্য সংগ্রহ করতে হবে। সর্বোচ্চ সদস্য সংগ্রহে অভিযান চলবে মাসব্যাপী। এই অভিযান পরিচালনা করবেন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।”
এ ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন সেখানে উপস্থিত দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “যেসব জেলায় সম্মেলন করা হয়েছে, সেগুলোতে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে হবে। এর মধ্যে যারা কমিটির নামের তালিকা জমা দেয়নি, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। যেসব কমিটির নাম জমা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সাংগঠনিক নিয়মে সমাধান করতে হবে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকরা ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বসে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”
প্রাথমিক সদস্যপদে আবেদন করতে পারবেন যারা
আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হতে প্রথমে ত্রিবার্ষিক ২০ টাকা চাঁদা দিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে। প্রাথমিক সদস্যপদ পেতে নতুন ভোটারদের দলের গণতন্ত্রের ১০০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত যোগ্যতা পূরণ করতে হবে। ১৮ বছর বা তার উপরের যেকোনো বয়সের বাংলাদেশি নারী-পুরুষ এই আবেদন করতে পারবে।
গণতন্ত্রের ৫(১) ধারা অনুযায়ী আবেদন ফরম পূরণের যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জননিরাপত্তা-বিরোধী এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত নন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারী বা নাগরিকত্ব বাতিলকৃত ব্যক্তি নন। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। ধর্ম, পেশা এবং জনগত শ্রেণি ও বর্ণের ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্যে বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি কোনো সংগঠনের সদস্য। কার্যনির্বাহী সংসদ কর্তৃক নির্দেশিত ন্যূনতম প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও যেকোনো নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবে। ত্রি-বার্ষিক চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করবেন।
উপরে বর্ণিত ওইসব যোগ্যতা যাদের মধ্যে আছে, শুধুমাত্র তারাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন।
দলীয় সূত্র বলছে, সারা দেশে নতুন ভোটারদের আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম শুরু হবে। ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ নীতির আলোকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শভিত্তিক আগামী প্রজন্ম গঠন করতেই এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম একজন সদস্য বলেন, “গত বছর দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে রেকর্ডসংখ্যক জেলায় সম্মেলন করা হয়েছে। তবে সম্মেলনের পর অনেক জেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। মূলত অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং কেন্দ্রীয় কিছু নেতার হস্তক্ষেপের কারণেই তা সম্ভব হয়নি। এখন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্মেলন হওয়া জেলাগুলোতে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার নির্দেশ হওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে।”
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, “আমাদের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম সারা বছরই চলে, যা এখনো চলমান। রমজান মাসজুড়ে সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলবে। এ ছাড়া রোজার কারণে একটু সীমিত হলেও সাংগঠনিক কার্যক্রম ও কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে চলবে।”
একইকথা বলেছেন দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, “সারা বছরই দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এই রমজান মাসে সদস্য সংগ্রহ অভিযান প্রোগ্রাম হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। মাসব্যাপী চলবে এই কর্মসূচি। এর ফলে বিপুলসংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করি।”
