রাজধানীতে জনপ্রিয় হচ্ছে লাইভ বেকারি। এখানে তাৎক্ষণিক ব্রেড, বিস্কুটসহ বিভিন্ন বেকারি পণ্য উৎপাদন করে বিক্রি করা হয়। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে লাইভ বেকারি।
সে রকমই একটি বেকারির মালিক মোহাম্মদ নাঈম। রাজধানীর রামপুরায় হট বেকারি নামের একটি দোকান রয়েছে তার। গত কোরবানি ঈদের আগে ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। সড়কের পাশে ছোট একটি দোকান নিয়ে সামনের দিকে কেক, রুটি, বিস্কুট, পেটিসসহ অন্যান্য সামগ্রী সাজিয়ে রেখেছেন। আর দোকানের ভেতরে এসব খাবার বানানোর জন্য মেশিন রয়েছে তার। বেকারির এসব খাদ্য বানানোর জন্য দুজন কর্মীও রেখেছেন। খাবারের মান, স্বাদ ও দাম তুলনামূলক কম থাকায় ক্রেতাদের চাহিদা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভালো আছেন বলে সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদকে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “ব্যবসার এখনো এক বছর হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ ক্রেতাদের সন্তুষ্টি দেখে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করছি। এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতা এসে বলেলনি খাবারের মান খারাপ বা পেট খারাপ করেছে। বরং আমার দোকানের তৈরি হওয়া এসব বেকারির খাবার গরম পাচ্ছেন তারা। ভেতরে দুজন কর্মী এসব খাবার বানাচ্ছেন আর আমিসহ আরেকজন আছেন, আমরা বিক্রি করছি।”
মোহাম্মদ নাঈম আরও বলেন, “বিএসটিআই, ভোক্তা অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে আমরা ব্যবসা করছি। বিশেষ করে ঢাকার অন্যান্য বেকারির চেয়ে আমাদের এই খাবারের দাম কমানোর চেষ্টা করছি। বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় হুট করেই পরিকল্পনা ছাড়া আমরা দাম কমাতে পারি না। অনেক কিছু ভেবে চিন্তা করেই কাজ করতে হয়।”
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাঈম বলেন, “ক্রেতা ভালো থাকলে দৈনিক ১০ হাজারের ওপরে বেচাবিক্রি হয়। আর ক্রেতা মন্দা হলে যা হয় তা-ও আলহামদুলিল্লাহ। তবে এভারেজ ৮-১০ হাজার বিক্রি হয় বলা যায়।”
তার দেওয়া তথ্যমতে, রামপুরাসহ রাজধানীর আরও বিভিন্ন জায়গায় এসব লাইভ বেকারি গড়ে উঠেছে। সড়কের পাশে ছোট দোকান ভাড়া করে ছোট উদ্যোক্তা হিসেবেই এসব লাইভ বেকারির কার্যক্রম চলছে।
জানা গেছে, রুটি, পেজগি রুটি, ক্রিম বান, এসপি রুটি, বন রুটি, পেটিস, বিফ রোল, স্যানডুইচ, পেস্ট্রি কেক, জন্মদিনের কেক, বিস্কুট, ড্রাই কেক, কেক প্লেইন পাউন্ড, ফুড কেক পাউন্ড, ওভালটিন কেক পাউন্ড, চিজ ফিংগার, বাটার বান, ডেনিস, বাখরখানি বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে।
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা হিসেবে মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, কারওয়ান বাজারের পাশাপাশি রামপুরাকেও ধরা হয়। এখানে অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুলসহ গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। রাত পেরিয়ে সকাল হলেই সাধারণের সরব উপস্থিতিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এখানকার ছোট-বড় সড়কগুলো। কর্মজীবনের ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় অনেকরই কাছে দুপুর কিংবা সন্ধ্যায় ভরসা হয়ে ওঠে এখানকার ফুটপাতে খাবার। তবে ফুটপাতের খাবারের মান নিয়ে অনেক সময় নানা প্রশ্ন উঠলেও তবুও তোয়াক্কা নেই সাধারণের। কিন্তু নতুন করে এখানে লাইভ বেকারি গড়ে ওঠায় যে কেউ চাইলেই গরম কেক বা গরম রুটি খেয়ে দুপুরের হালকা-পাতলা খাবার সেরে ফেলতে পারেন। খাবারের মান নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে কোনো অভিযোগ না থাকায় দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলেও মন্তব্য আশপাশের ব্যবসায়ীদের।
এক প্যাকেট বাখরখানি কিনতে নাবিল স্পেশাল লাইভ বেকারিতে এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব রহমত উল্লাহ। বিক্রেতা জুয়েল দাম হাঁকান ১২০ টাকা। রহমত উল্লাহ দিতে চান ১০০ টাকায়। প্রায় ৫ মিনিট তাদের দুজনের মাঝে কথা চলাকালে একসময় বিক্রেতা ১০০ টাকায় বাখরখানি দিতে রাজি হন।
কেন এক প্যাকেট বাখরখানিতে ২০ টাকা কম রাখলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিক্রেতা জুয়েল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের বেকারিতে সীমিত লাভে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। খুব বেশি লাভের আশায় আমরা ব্যবসা করি না। সাধারণ মানুষের কাছে ভালো খাবার সহনীয় দামে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কাজ। এর মধ্যে যে লাভ হয়, তা নিয়েই আলহামদুলিল্লাহ আমরা আল্লাহর দরবারে সন্তুষ্ট। মানুষ যেন ভালো বলতে পারে সেজন্যই আমরা অনেক সময় ১০ টাকা কমও রেখে দিই।”
এক মাস আগেও এই বেকারি থেকে বাখরখানি কিনেছিলেন ষাটোর্ধ্ব রহমত উল্লাহ। বাসার সবাই খেয়ে খুব প্রশংসা করেছেন। মান ও স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় আবার এসেছেন বাখরখানি কিনতে। তবে এবার আর শুধু বাখরখানি নয়, সঙ্গে আরও কিছু কিনবেন বলে আগেভাগেই পরিকল্পনা করে এসেছেন।
তিনি বললেন, “ছোট নাতি গরম কেক খেতে খুব পছন্দ করে। ঢাকায় তো গরম কেক পাওয়া খুবই দুষ্কর। কারণ ঢাকার বাইরে থেকে কেক আসে, সেই কেক দোকানে রাখা হয়। ক্রেতারা যখন কিনেন তখন আর কেক গরম থাকে না। শুনলাম দোকানের ভেতরে বেকারির তৈরি খাবারের মেশিন বসিয়ে খাবার তৈরি করে বিক্রি করেন রামপুরায়। তাই একদিন অফিস শেষে করে এসে টেস্ট করার জন্য বেকারি থেকে বাখরখানি কিনে বাসায় নিয়েছিলাম। এক প্যাকেট বাখরখানি বাসায় কাড়াকাড়ি করে খেয়ে শেষ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। আমি যে একটু টেস্ট করব তা হয়েই ওঠেনি। তারা যে খাবারের প্রশংসা করেছেন তাতেই আমার মন ভরে যায়। তাই আবার আসলাম বেকারিতে খাবার কিনতে।”
রহমত উল্লাহ আরও বলেন, “সাধারণত বেকারির খাবারের মান নিয়ে অনেক সময় সবার মাঝে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। পুষ্টিগুণে ভরপুরের কথা বলা হলেও আসলেই বেকারির খাবারে তেমন বেশি পুষ্টি নেই বললেই চলে। সব মেশিন আর কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা হয়। আবার এর সঙ্গে রংও মেশানো হয়। তবুও আমরা বাঙালি পাতলা খাবারের তালিকায় এসব খাবারই প্রথমে রাখি। চাকরি জীবনে বাসায় আর তিন বেলা খাবার পেটপুরে খাওয়া হয় না। তাই পেটের চাহিদা মেটাতে আমাদের ভরসা হয়ে উঠে এসব খাবারই।”
তথ্য বলছে, দেশে দুই ধরনের বেকারি রয়েছে। একটি হস্তচালিত (হাতে তৈরি নন-ব্র্যান্ড) বেকারি। দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজার এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা হাতে তৈরি পণ্য দেশের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। অন্য ধরনটি অটো ও সেমি-অটো বেকারি। দেশে ১০০টির মতো এ ধরনের বেকারি রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড়। এ ছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী আরও প্রায় ১৫টি কারখানা করেছে। যেগুলো এখন বেকারি ব্র্যান্ড। আকিজ, প্রাণ, ফ্রেশ এদের মধ্যে অন্যতম।
প্রায় এক দশক ধরে সার্বিক বেকারির বাজার বড় হলেও সে সুযোগ নিতে পারেনি হাতে তৈরি সনাতন ব্কোরিগুলো। তবে অটো ও সেমি-অটো বেকারি ব্যবসার সাফল্যের মুখ দেখলেও সনাতন বেকারিগুলো অনেকটা খুঁড়ে খুঁড়ে চলছে। তাদের কাছে বর্তমান বাজারে টিকে থাকাই যেন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, করোনা মহামারিতে ১২ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বেকারিশিল্প। সেই ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বেকারি খাতের ব্যবসায়ীরা। টিকে থাকার লড়াইয়ে কেউ টিকে আছেন, কেউবা ছিটকে পড়েছেন এই খাত থেকে। এ ছাড়াও গত এক বছরে বেকারি উপাদানের দাম বেড়ে যাওয়া, শ্রমিক খরচ বৃদ্ধিসহ ইউটিলিটি বিলও বেড়েছে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ হয়ে গেছে দ্বিগুণ।
রাজধানীতে আগে বেকারির সংখ্যা গুটি কয়েক ছিল। সেগুলোও আবার ব্র্যান্ডের বেকারি। তবে করোনা মহামারির পর থেকে বেকারিশিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট করে আবারও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই শিল্প ঘুরে দাঁড়ালে অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে জানালেন নাবিল স্পেশাল লাইভ বেকারির বিক্রেতা জুয়েল।
জুয়েল বললেন, “লাভের আশায় সবাই ব্যবসা করতে আসে। অথচ ব্যবসায় নামলে যে প্রথমে লোকসানের ঘাটতি টানতে হবে, এটা অনেকেই মানতে চায় না।”
জুয়েল বলেন, “বেকারিশিল্প বড় শিল্প। দেশের মানুষের খাবারের চাহিদা মেটানোর কথা চিন্তা করলেই বোঝা যায়। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। এখানে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বসবাস করেন। এই আড়াই কোটি মানুষ অনেকটাই নির্ভর থাকে হালকা-পাতলা খাবারের ওপর। অনেক সময় দেখা যায় সারা দিন অফিসে থাকাকালীন দুপুরের সময় ভারী খাবার খাওয়ার চেয়ে একটা কেক বা রুটি অথবা বিস্কুট খেয়ে চা খেয়ে নিল। এমন মানুষ ঢাকায় অনেক বলা চলে।”
জুয়েল আরও বলেন, “একটা সময় ছিল ঢাকার আশপাশে অনেক বেকারি ছিল। আবার এমনও সময় দেখেছি সেগুলো কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমাদের মতো স্বল্প মানুষ বেকারি ব্যবসায় আবারও ফিরতে শুরু করেছে। যেমন আমার দোকানের মালিক দোকানে বসেন না। দোকানে আমি আর একজন কর্মী আছে। আমরাই খাবার বানাই আমরাই বিক্রি করি। দোকানের মালিক সন্ধ্যায় এসে একটু বসে। এইভাবে যদি স্বল্প কর্মী দিয়ে বেকারি ব্যবসা আরও শুরু করা যায় তাহলে বেকারিশিল্প আবারও বড় হবে। দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক ভূমিকা রাখবে।”