সারা দেশে মুজিবর্ষ পালনে নির্মাণ করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য। এতে খরচ হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ উপলক্ষে দুই বছর ছিল নানা জমকালো আয়োজন।
সোমবার (১১ নভেম্বর) ইনডিপেন্ডেট টিভির অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
বিশিষ্টজনদের মতে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনবান্ধব কাজে ব্যয় করা উচিত। তারা বলছেন, মুজিববর্ষ পালন এবং ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণে অপচয়ে জড়িত ও দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে খরচ হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকার বেশি। রাঙামাটি শহরের উপজেলা পরিষদের সামনের ম্যুরালটি নির্মাণে ব্যয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সব জেলা পরিষদে এমন ম্যুরাল নির্মাণে খরচ হয় ৮ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত।
জানা যায়, ২০২১ সালের মার্চে উচ্চ আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়, দেশে বঙ্গবন্ধুর মোট ১ হাজার ২২০টি ভাস্কর্য ও ম্যুরাল আছে। বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য ও ম্যুরালের মধ্যে খুলনা বিভাগে ২১টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২টি, ঢাকা বিভাগে ৪১টি, বরিশাল বিভাগে তিনটি, ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচটি, রংপুর বিভাগে চারটি, রাজশাহী বিভাগে ৯টি এবং সিলেট বিভাগে একটি স্থাপন করা হয়। এর বাইরেও কয়েক হাজার ভাস্কর্য-ম্যুরাল নির্মাণ ও স্থাপন করা হয়েছে।
শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নয়, ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে তার স্বজনদেরও। এমনকি তার বইয়েরও। সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ১২টি সিটি করপোরেশন, ৬৪টি জেলা, ৪৯৫টি উপজেলা, ৩৩১টি পৌরসভা ও চার হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়নের সব কটিতেই ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের নির্দেশ ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। জেলা-উপজেলা পরিষদে ম্যুরাল নির্মাণ করা হলেও সব ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। আগামী বছরের মধ্যে সব ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ম্যুরাল বা ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য পৃথক কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের বাজেট বরাদ্দ থেকে এই খাতে ব্যয় করা হয়। এলজিইডি এতে কারিগরি সহায়তা করে। এগুলো অতিরিক্ত হয়েছে, যা উচিত হয়নি।’
এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বসানো হয় ম্যুরাল। বাদ যায়নি প্রাইমারি স্কুলও। স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দেওয়া স্লিপ ফান্ডের টাকা দিয়ে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বোর্ড, অধিদপ্তর বা সংস্থার প্রতিটিতে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। এভাবে মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে অন্তত ৭০০ কার্যালয়, সংস্থা-দপ্তর রয়েছে, যার বেশির ভাগেই ম্যুরাল ছিল। এগুলোর কোনোটিতে ৩০ লাখ, আবার কোনোটিতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি সংস্থা রয়েছে, যার প্রতিটি কার্যালয়েই ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। এমনকি কোনো কোনো আঞ্চলিক কার্যালয়েও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। সড়কের শুরুতে, শেষে, চৌরাস্তায়, নদীর তীরে, পুকুরপারে, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায়—এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এগুলো বসানো হয়নি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যুরালের নকশা ও ডিজাইন তৈরিতে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া স্থাপনা এবং অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে এর মোট ব্যয় হয় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা।
রাজধানীতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অর্থায়নে তৈরি করা ম্যুরালটির উচ্চতা ১০ ফুট ও প্রস্থ আট ফুট। নির্মাণে সময় লাগে তিন মাস। ব্যয় হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ বেতার পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় মুর্যাল নির্মাণ করে।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তড়িঘড়ি করে দুই প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। দুই প্রান্তে দুটি উদ্বোধনী কমপ্লেক্সে একটি করে ম্যুরাল ও উদ্বোধনের ফলক রয়েছে। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের দুই ম্যুরালেই ব্যয় হয় ১১৭ কোটি টাকা। রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহর ৩০০ ফুট এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ৭১ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্যসহ ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’-এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৫৫ কোটি টাকা। দোলাইরপাড়ের জন্য চীন থেকে ভাস্কর্য নির্মাণ করে দেশে আনা হয়েছিল। ভাস্কর্যটি বানাতে ব্যয় হয়েছিল ৯ কোটি টাকা। কিন্তু ইসলামী দলগুলোর আপত্তির কারণে সেটি আর স্থাপন করা যায়নি।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্ট এলাকায় ভাস্কর্য স্থাপন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ১৫ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্যটি তৈরিতে খরচ করেছিল ২৩ লাখ টাকারও বেশি।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশন খুলনা নগর ভবনে প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে ম্যুরাল তৈরি করে। রাজশাহীতে নগরীর সিঅ্যান্ডবি এলাকায় দুই কোটি দুই লাখ টাকা ব্যয়ে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়। এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে মুরাল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে ৮২ লাখ টাকা ব্যয় করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বজ্রকণ্ঠ নামের ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপন কাজে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ব্যয় করে ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর উচ্চতা সাড়ে ২২ ফুট, বেইসসহ (বেদি) পুরো ভাস্কর্যের উচ্চতা ২৬ ফুট। সাদা সিমেন্টের ঢালাইয়ের মাধ্যমে তৈরি ভাস্কর্যটির ওজন প্রায় ৩০ টন।
দেশের প্রতিটি জেলা পরিষদে নির্মাণ করা হয় ম্যুরাল। এসব ম্যুরালে আট লাখ থেকে এক কোটি টাকার বেশিও ব্যয় করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে ব্যয় হয় এক কোটি সাত লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বাগেরহাট জেলা পরিষদের সামনে ম্যুরালটি নির্মাণে ব্যয় হয় ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা। রংপুর জেলা পরিষদের অর্থায়নে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। প্রায় তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রাঙামাটি শহরের উপজেলা পরিষদের সামনে বিশাল ভাস্কর্য ও ম্যুরাল নির্মাণ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ম্যুরাল নির্মাণ করে বগুড়া জেলা পরিষদ। মানিকগঞ্জে ম্যুরাল ঘিরে তৈরি করা হয় বঙ্গবন্ধু চত্বর। জেলা পরিষদের অর্থায়নে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরটি নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া যশোর শহরের বকুলতলায় যশোরের জেলা প্রশাসনের টাকায় ম্যুরালটি নির্মাণ করা হয়। ব্যয় হয় ৫৪ লাখ টাকা।
২০১২ সালে এক হাজার ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুন নাগাদ দেশের আটটি বিভাগের ৬৩টি জেলার ৪৭০টি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণের লক্ষ্যে ‘উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ শীর্ষক’ একটি প্রকল্প নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কমপ্লেক্সের সামনে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ম্যুরালের জন্য ব্যয় ধরা হয় ছয় লাখ টাকা।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, “যেকোনো খরচের ক্ষেত্রে খরচের সদ্ব্যবহার খুব জরুরি। আমরা যে ট্যাক্স পেয়ারস টাকাটা ব্যবহার করছি, সেটা জনগণের কল্যাণের জন্য যাতে সরাসরি হোক বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার একটা সম্পৃক্ততা থাকে। সরকারি যেকোনো ব্যয় করি না কেন, সেটা অবশ্যই আমাদের জনস্বার্থে হওয়া উচিত।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বহুমাত্রিক রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। এসব ব্যয়ে কোনো প্রকার প্রকল্প নেওয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা বা আয়-ব্যয়ের হিসাব থেকে শুরু করে কোনো ধরনের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা বা কোনো কিছুই কিন্তু নিশ্চিত করা হয়নি।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা আশা করব, এই চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।”
এদিকে, মুজিববর্ষে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ টাকা অপচয় করা হয়েছে, তার খোঁজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “আপনারা জানেন মুজিববর্ষকে ঘিরে কীভাবে একটা উন্মাদনা হয়েছে। মুজিববর্ষে কী ধরনের কাজ হয়েছে, কত টাকা অপচয় হয়েছে সেটা নিয়ে ডকুমেন্ট করার কথা উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। মুজিববর্ষের নামে কোন কোন মন্ত্রণালয় কত কোটি টাকা খরচ করেছে তা নিয়ে ডকুমেন্টেশন হবে, সেগুলোর একটা লিস্ট করা হবে।”