• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘ঢাকায় টাকা ওড়ে, শুধু জানতে হয় ধরতে’


বিজন কুমার
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৪:০৭ পিএম
‘ঢাকায় টাকা ওড়ে, শুধু জানতে হয় ধরতে’

রাজধানী ঢাকা, অতিরিক্ত জনঘনত্বের এক শহর। প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস এখানে। জনসংখ্যার কোলাহল ঘিরে অনেকেই নানান কিছু ভেবে থাকেন। ভাবেন দেশের আনাচে-কানাচের মানুষরাও। যেমন- ‘ঢাকায় টাকা উড়ে, শুধু জানতে হয় ধরতে।’ ঠিক এমন চিন্তা থেকেই কর্মের সন্ধানে অনেকে পাড়ি দেন ব্যস্ত এই শহরে। এখানে এসে কেউ অন্যের অধীনে কাজ করেন। আবার অনেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ফুটপাতসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়ে উঠেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

সংবাদ প্রকাশের এই গল্পটা ঢাকার ‘ফুটপাতের উদ্যোক্তাদের’ নিয়ে।

পাখির চোখে রাজধানী ঢাকা যেন হাজার হাজার দালানের স্তুপ। আর সর্পিল পিচঢালা পথের চারদিকে উঁচু দালান। রাস্তার পাশে ফুটপাত। ঘরে বাইরের নানা প্রয়োজনের পণ্য পাওয়া যায় এ ফুটপাতেই। ডালিতে, ভ্যানে, মাদুরে, রেক্সিনে এসব পণ্যের পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করেন এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। ফুটপাত ধরে হাঁটলে হাতের কাছেই মেলে প্রয়োজনের পণ্যটি। পান-সিগারেট, সাজ-সজ্জা, পরিধেয় বস্ত্র, ঘরের টুকিটাকি থেকে শুরু করে সবই মেলে এই রাজপথের পাশে। 

এই পথ ধরে হেঁটে হেঁটে কথা হয় এদের অনেকের সঙ্গে। এরা বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের। কাজের সন্ধানে এসেছেন এই শহরে। কেউ কাজ করছেন, আবার কেউ কাজ হারিয়ে হয়ে উঠেছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আনন্দ সিনেমা হলের পাশেই গাছ বিক্রি করেন বাদশা মিয়া। তার দোকানে রয়েছে কয়েক জাতের ফুল ও ওষুধি গাছ। তিনি ১২ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন। তিনি এসেছেন ল²ীপুর জেলা থেকে। 

বাদশা মিয়া সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকায় টাকা আয় করতে হলে কষ্ট করতে হয়। আমি যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন শুধু বরিশাল আর ঢাকাতেই গাছের ব্যবসা ছিল। এখন সব জায়গায় বিক্রি শুরু হইছে। এই শহরে কিছু করতে হলে কষ্ট করতেই হবে ভাই। আমি যখন গাছ কিনতে আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জে যাই। তখন যাওয়ার সময় খালি ভ্যানে লাগে কম সময়। আর আসার সময় ভাই ৮ ঘণ্টা লেগে যায়। কি যে কষ্ট লাগে! আমিই জানি।” 

তিনি আরও বলেন, “শুরুর দিকে আমার পুঁজি ছিল দুই হাজার টাকা। আর এখন আল্লাহ দিলে দোকানেই গাছ আছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার। দেশে ব্যবসা করতে যেতে চাই না। এখানকার ব্যবসাতে মন বসেছে। প্রতিদিন বিক্রি হয় ১৫’শ থেকে ২ হাজার টাকা। এতে যা লাভ হয় নিজে চলি। দেশে পরিবার আছে ওদের পাঠাই। চলে যায় অনেক ভালো। আল্লাহ ভরসা ভাই।”

একই এলাকায় পাওয়া যায় পান সিগারেটের ব্যবসায়ী লাভলী আক্তারকে। বয়স প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি। তিনি বলেন, “প্রথমে কাগজ, বোতলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে টোকাইয়ের কাজ করে জীবন চালিয়েছি। তারপর পত্রিকার হকারি। আর সবশেষে ৫ হাজার টাকার পুঁজিতে পান-সিগারেট আর চকলেট নিয়ে বসেছি।”

লাভলী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। মায়ের কোলে জন্ম নেয়ার পর থকে কষ্ট শুরু। এই জীবনে কত কি করলাম। আমাদের রাস্তায় শুইলে মাইর খেতে হয়। প্রথমে রাস্তায় টোকাইতাম, তারপরে পত্রিকা বিক্রি করছি। যা জমাইছিলাম, তা দিয়ে এই ১০ বছর থেকে এখানে পানের দোকান করি। এখন ব্যবসা তেমন একটা ভালো নেই। জিনিপত্রের দাম বেশি। বাড়ি ভাড়া দিতে গেলে খাওয়ার টাকা হয় না। এখন সারাদিনে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এতে যা লাভ হয়। তা দিয়েই চলে।”

পান্থপথের ফুটপাতে পাওয়া যায় নিজাম নামের এক উদ্যোক্তাকে। তিনি আগে গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলেন। এখন মেয়েদের সাজ সজ্জার জিনিসপত্র বিক্রি করেন তিনি। তার দোকানে আছে, মেয়েদের কানের দুল, নকশা বসানো চুরিসহ অনেক কিছু।

নিজাম বলেন, “আমি এই ব্যবসা করি ৪ থেকে ৫ বছর ধরে। মোটামুটি ব্যবসা হয়। খায়ে-দায়ে চলে আরকি। এখানে একাই থাকি, পরিবার দেশে থাকে। এসব জিনিসপত্র আমি চক বাজার থেকে নিয়ে আসি। তিন হাজার টাকা বিক্রি করলে, লাভ থাকে ৫ থেকে ৭’শ টাকা। এই ব্যবসাটা মাসের ১৫ দিন বেশি হয় আবার বাকি দিন কম। আগে গার্মেন্টসে প্রোডাকশনে কাজ করতাম। ওই কাজ বন্ধ হওয়ার পরে চাকুরি খুঁজছিলাম পাই নাই। ৫০ হাজার টাকা জমাইছিলাম। সেই দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি।” 

গাইবান্ধা জেলা থেকে ২০০৪ সালে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন এমদাদুল হক মোল্লা। প্রথমে অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসাবে কাজ করেছেন ২ বছর। এরপর ২০০৬ সালে জমানো ৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজেই কারওয়ান বাজার এলাকার ফুটপাতে বিক্রি শুরু করেন মোবাইল ফোনের কাভারসহ বিভিন্ন প্রকারের হেডফোন।

তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকায় টাকা উড়ে, শুধু জানতে হয় ধরতে। এই কথা সত্য। আপনি ঢাকায় এসে যদি কষ্ট না করেন, তাহলে টাকা উড়ে উড়ে আপনার কাছে আসবে না। কষ্ট করতে হবে, টাকা ধরতে হবে। আমি প্রথমে এসে অন্যের দোকানে ২ বছর কাজ করেছি। তারপর ৬ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করছি ২০০৬ সালে। দেশে বউ বাচ্চা আছে। এখানে সারাদিনে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এতে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা লাভ থাকে। এখন আল্লাহ্ দিলে মোটামুটি ভালো চলে।” 

কারওয়ান বাজারের মানিব্যাগ বিক্রি করা সফিকুল আলম বলেন, “আমার ব্যবসার পুঁজি ছিল ৬০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ৫ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেছি। এখন ব্যবসা ভালো না। তবে আশা করা বাদ দেই নাই। আল্লাহ প্রতিদিন চালাচ্ছে তো। এখন দোকানে প্রায় ৭০ হাজার টাকার মালামাল আছে।”

Link copied!