বড় কোনো সংশোধনী ছাড়াই জাতীয় সংসদে অর্থবিল উত্থাপন হচ্ছে আজ। আর আগামীকাল রোববার (৩০ জুন) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে, যা নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন (১ জুলাই) কার্যকর হবে।
এর আগে ৬ জুন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে আসন্ন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ওই সময় উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোয় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটছে না বলে সূত্রে জানা গেছে।
এবারের বাজেটে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি। এ নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে নানা মহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ প্রস্তাবে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না।
বাজেট প্রস্তাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ওপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বসানোর কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এতে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আপত্তি থাকলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
সংশোধনী বাজেটে আগের মতোই ৫০ লাখ টাকা লাভের ওপর কর আরোপের সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে আভাস পাওয়া গেছে। এর ফলে পতনের মধ্যে থাকা বাজার আরও খারাপের দিকে যাবে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ এ কর বাতিলের দাবিতে বিবৃতিও দিয়েছে। যদিও এনবিআর এ কর প্রত্যাহার করবে না বলে জানা গেছে।
তবে নতুন অর্থ বিলে আয়কর ও কাস্টমস সংক্রান্ত সামান্য কিছু পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চাপে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কগুলোর কর অবকাশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থাৎ এসব অঞ্চল ও পার্কের কর অবকাশ সুবিধা আগের মতোই বহাল থাকছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্কও আগের মতো শূন্য শতাংশ রাখা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য ডেভেলপারদের আমদানি করা যন্ত্রপাতির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। শিল্প স্থাপনের মূলধনি যন্ত্রপাতিতেও ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত সপ্তাহে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর সুবিধা প্রত্যাহারসহ ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এসব সুবিধা বহাল রাখার নির্দেশনা আসে।
এছাড়া সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন নাও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাজেট উত্থাপনকালে সব নাগরিককে কর প্রদানে উৎসাহিত করতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। তবে সংসদ সদস্যদের চাপে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাবটি টেকার সম্ভাবনা কম বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
প্রস্তাবিত বাজেট পাসের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন বলেন, “সব সময়ই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের বিষয়টি আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাজেট পরিকল্পনায় থাকে। তিনি ধাপে ধাপে ওই লক্ষ্যটায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। সব সময়ই বাজেট করার আগেই উনি এটা খেয়াল রাখেন। উনি জনগণকে যে ওয়াদা করেছেন সেটা প্রতিফলন থাকবে বলে আমি মনে করি। যে বাজেট প্রস্তাবটা এসেছে তার অধিকাংশই পাস হবে।”
কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে রিটার্ন জমার স্লিপ প্রদর্শনের শর্তে পরিবর্তন আসছে। সেক্ষেত্রে পৌর এলাকা বা গ্রামাঞ্চলে এ স্লিপ প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়বে না। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় তা প্রদর্শন করতে হবে।
সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক হিসেবেই দেখছেন। তাদের ভাষ্যমতে, অর্থনীতির চলমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় এতে কোনো নতুনত্ব আনা হয়নি।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় আরও কমিয়ে ঋণ গ্রহণের নির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিত ছিল বলে মনে করছে জাতীয় পার্টি। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেন, “এটি একটা গতানুগতিক বাজেট। উচিত ছিল উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে রাখা, পরিচালন ব্যয় আরও কমানো। ঋণ যাতে কম নিতে হয়, সেই ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশে যারা আয় করে, তারা ট্যাক্স দেয় না। ঋণখেলাপ যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি হুমকিতে পড়বে। আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক কারণে তৈরি হয়নি। এটা হয়েছে জবাবদিহিতার অভাবে এবং সুশাসন না থাকায়। দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রসার ঘটেছে, যা টেনে ধরার কোনো উপায় রাখা হয়নি।”
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, “প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি থেকে সরে আসার একটা প্রয়াস দেখা গেছে। ঘাটতি বাজেটও ৫ শতাংশের ঘরে ধরে রাখা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও পূরণ হবে না। এটা ৭ শতাংশ হলেও আমি খুশি। সংসদের বাজেট আলোচনায় আমরা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অপচয়ের জৌলুস নিয়ে কথা বলেছি। গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের কথা বলেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় বাধ্যতামূলকভাবে ডাক্তারদের দুই বছর নিয়োগের বিধান করতে বলেছি। যতটা পেরেছি যেসব বিষয় বলা দরকার, সেগুলো আমরা তুলে ধরেছি। সর্বোপরি একটি ধারাবাহিক বাজেট পাস হতে যাচ্ছে।”