• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কারওয়ান বাজার স্থানান্তর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যবসায়ীদের


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: মার্চ ২৮, ২০২৪, ০৯:৫৬ পিএম
কারওয়ান বাজার স্থানান্তর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যবসায়ীদের
কারওয়ান বাজার। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত কারওয়ান বাজার। এ বাজারের রয়েছে ভিন্নধর্মী কিছু বৈশিষ্ট্য। আলাদা আলাদা পণ্যের নির্ধারিত আড়তগুলোই এ বাজারের প্রধান চালিকাশক্তি। রয়েছে মাছের বিশাল পাইকারি আড়ত। দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফল পাওয়া যায় এখানে। মাছ, মুরগি, শুঁটকি, সবজি, মসলা, মুদি পণ্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাইকারি বিক্রি হয় এ বাজারে। তাই ঢাকাবাসীর কাছে এ বাজার প্রধান ভরসার জায়গা। তবে ঈদের পর সে ভরসার জায়গা হারাতে বসেছেন ঢাকাবাসী। কারণ, কারওয়ান বাজারের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বাজার গাবতলীতে স্থানান্তর করা হবে। ফলে বাজার স্থানান্তর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের কথা বলা হচ্ছে। তবে আজও সেটা কার্যকর করা হয়নি। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ঈদের পরে গাবতলীতে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবে। যদি গাবতলীতে বাজার স্থানান্তর করা হয়, তাহলে সেখানে অনেক ব্যবসায়ী যেতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন না।

আলিফ নামের এক ব্যবসায়ী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া জেনে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঢাকার ঐতিহ্য এখন হঠাৎ করে ব্যকসাইডে চলে যাবে, এটা কেউ মেনে নিতে চায় না। বিশেষ করে যাদের বাসা ধানমন্ডি, রামপুরা, মগবাজার, মৌচাক, বাসাবো, তাদের জন্য গাবতলী গিয়ে ব্যবসা করা অসম্ভব। ফলে যেটা হবে, কারওয়ান বাজারে যেমন দোকান, ব্যবসায়ীদের মাঝে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা আমেজ বিরাজ করত; গাবতলীতে গিয়ে সেটা করবে না। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ছন্নহারা হয়ে যাবেন।”

আলিফ আরও বলেন, “কারওয়ান বাজার ঢাকার মাঝ পয়েন্টে অবস্থান। সবাই এখানে আসতে পারে। কিন্তু গাবতলীতে গিয়ে অনেকেই যেতে পারবে না। এখান থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পেত, গাবতলীতে গেলে সে পরিমাণ পাবে না। তাই স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হলেও আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা এটাকে সমর্থন করি না বললেই চলে। তবে সরকার যেহেতু স্থানান্তরের কথা বলেছেন, তাই আমাদের এখানে করার কিছু নেই।”

জানা গেছে, ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এখানে প্রথম বাজার বসান। ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল এনে পাইকারি বিক্রি করতেন তিনি। তার কাছ থেকে ফল কিনে নিতেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। সে সময় ক্রেতারা কারওয়ান সিংয়ের ফল নিতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে মানুষ ওই বাজারকে ডাকতে শুরু করেন কারওয়ান সিংয়ের বাজার। কালক্রমে তা রূপান্তর হয়ে কারওয়ান বাজার হিসেবে।

তবে বাজারের নামের উৎপত্তি বা ইতিহাস নিয়ে আরও অনেক মত প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এখানে কোনো একসময় গরু দৌড়ের আয়োজন হতো। যা তখনকার আমলে বেশ আলোচিত ছিল। সেই ‘কাউ (গরু)’ ও ‘রান (দৌড়)’ থেকে জায়গাটির নাম হয় কাওরান বাজার। মৌখিকভাবে আজও অনেকেই কাওরান বাজারই বলে। রাজধানীতে নতুন আগন্তুকরা বলে ‘কারুণ বাজার’। তবে বইপত্র ও সংবাদমাধ্যমে এ বাজারের নাম লেখা হয় ‘কারওয়ান বাজার’।

দীর্ঘদিন ধরে কারওয়ান বাজারের মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে বিবেচনা করে বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া অনেক আগে থেকেই হাতে নেয় সরকার। তবে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। নানা সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার কথা বলা হলেও এখান থেকে বাজার স্থানান্তরের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে নেননি ব্যবসায়ীরা।

বাজার স্থানান্তরের বিষয়টি ব্যবসায়ীরা মানতে নারাজ বলে এক আলাপকালে সংবাদ প্রকাশের কাছে অভিমত প্রকাশ করেন কারওয়ান বাজারের আব্দুল হেলাল নামের এক ব্যবসায়ী।

আব্দুল হেলাল বলেন, “আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বাসা আশপাশেই। সকালে বাসা থেকে বাজারে আসি, রাতে বাজার থেকে বাসায় যাই; এভাবেই ৩৫ বছর কেটে গেছে আমার। বাবা ব্যবসায়ী ছিল, সেই সূত্রেই এখানকার ব্যবসা করা। কিন্তু বাংলাদেশে ঐতিহ্যে বাজার এভাবে হুট করেই পরিকল্পনা করে স্থানান্তর করাকে অনেক ব্যবসায়ী মানতে চাচ্ছে না। এখানে যেমন ‍সুবিধা পাওয়া যায়, গাবতলীতে সেভাবে সুবিধা পাওয়া যাবে না। আর পজিশন নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী সংশয়ের মধ্যে আছে।”

আব্দুল হেলাল আরও বলেন, “বাজার স্থানান্তরে অনেক ব্যবসায়ী ঝড়ে পড়ে যাবে। মালামাল ট্রাকে করে টেনে নিয়ে গাবতলী যাওয়া বড় ঝামেলার কাজ। তাই অনেকেই সেখানে যেতে চাইবে না। পাশাপাশি বাজার কমিটিতে বড় রদবদল আসবে। দোকান পজিশন নিয়ে অনেক ঝামেলা হবে। এছাড়াও আরও কত কি যে হবে, সেটা বলা মুশকিল। একটা সাজানো-গোছানো বাজার ভেঙে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে আবার গোছানো কতবড় কাজ, এটা ব্যবসায়ীরা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।”

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল হেলাল বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে বাজার রাখার আবদার করেছি। তবে সেটাতে কাজ হয়নি। এখানে বাজার থাকলে নাকি ঢাকার মধ্যে যানজটসহ জঙ্গল তৈরি হয়, এমন কথা অনেক সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। কিন্তু এখানে হাজারও মানুষের রুটি-রুজি আর কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এটা কেউ বলেন না।”

সূত্র বলছে, ঈদের পর থেকে গাবতলীতে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে বাজার স্থানান্তরের কাজ সম্পন্ন করা হবে। তবে প্রথমে আলুর মার্কেট স্থানান্তর করা বলে জানা যায়। কিন্তু এ সূত্রের সত্যতা কতটুকু তা নিশ্চিত হতে ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সভাপতি মো. বাবুল মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়-৫-এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “কারওয়ান বাজারে আমাদের সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিস আজ মোহাম্মদপুরের শিফট করার জন্য মালামাল ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে অফিস শিফট করা হবে। আমাদের অফিস শিফট করার মধ্য দিয়ে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমাদের অফিস যে ভবনে, সেটাই যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ, তাই আমাদের অফিস সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমেই শুরু করলাম।”

মোতাকাব্বীর আহমেদ আরও বলেন, “ঈদের পর স্থায়ী ১৮০টি এবং ১৭৬টি অস্থায়ী দোকান স্থানান্তর শুরু হবে। দোকানগুলো আমরা গাবতলীতে পুনর্বাসন করছি। ঈদের পর এই ভবনসহ এই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যাবে। এছাড়াও কারওয়ান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ বাকি মার্কেটগুলো পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেওয়া হবে।”

Link copied!