ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে উপকূলজুড়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ো বাতাস ও ভারী বৃষ্টিতে গাছ ও দেয়াল চাপা পড়ে এখন পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গাছপালা উপড়ে পড়ায় কয়েকটি জেলার আঞ্চলিক ও স্থানীয় সড়কে সাময়িকভাবে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তার ছিঁড়ে পড়ায় অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া কাঁচাঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘর ভেঙে পড়েছে। নিখোঁজ আছেন ২০টি ট্রলারের ৩০০ জেলে।
এদিকে, বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে মিধিলি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মোংলা ও পায়রা বন্দরে দেওয়া ৭ নম্বর বিপৎসংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের ৬ নম্বর বিপৎসংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর করা হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফে ভারী বৃষ্টিতে বসতঘরের মাটির দেয়াল ধসে একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া এলাকায় ওই চারজন নিহত হন। তারা হলেন ওই এলাকার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), তার ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, মিধিলির প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত আটটার পর থেকে কয়েক দফা ভারী ও মাঝারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী একটি পরিবারের চারজন নিহত হন।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ঝড়ের সময় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আবদুল ওহাব নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ওহাব সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। মিরসরাইয়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা গেছে ছিদরাতুল মুনতাহা নামের এক শিশু। মুনতাহা মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড়ের মহানগর এলাকার আনোয়ার হোসেনের মেয়ে।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর দুপুরে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে ঝড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রাজ্জাক মিয়া (৪০) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। রাজ্জাক মিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে। তিনি বাসাইলের কোটিপতি মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন।
টানা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় পটুয়াখালীতে রোপা আমন ফসলের ৭৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। জেলার ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর রোপা আমন ফসল ঘূর্ণিবাতাসের শিকার হয়েছে। এছাড়া খেসারিসহ মাঠে থাকা সবজিরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সৈয়দ জোবায়দুল আলম বলেন, বৃষ্টিতে শীতকালীন সবজি ও খেসারি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। টানা বৃষ্টিতে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প ও মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের ভেতর শীতকালীন সবজিসহ নানা জাতের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ফেনীর কৃষি বিভাগ বলছে, প্রতিটি উপজেলায় কয়েক হাজার হেক্টর পাকা আমন ধান জমিতে শুয়ে পড়েছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। ঝড়ের কারণে ধানের তেমন ক্ষতি না হলেও শীতকালীন সবজির কিছু ক্ষতি ও রবিশস্যের আবাদ পিছিয়ে যেতে পারে।
টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বাগেরহাটের কয়েক হাজার হেক্টর জমির বীজতলা। মাঠঘাট ও ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে থাকায় খেতের ধান ভেসে যাওয়া ও নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া চারা দেওয়ার জন্য বীজধান প্রস্তুত থাকলেও পানি ও বৃষ্টির কারণে বুনতে পারছেন না কৃষকেরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাগেরহাট কার্যালয়ের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে বোরো ধানের বীজতলা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এখনো সময় আছে, কৃষকেরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন। ঘেরের পাড়ের শীতকালীন সবজি ও আমন ধানে ঝোড়ো বাতাসে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
ঝড়ের আঘাতে চাঁদপুর শহরের রেলওয়ে আক্কাছ আলী একাডেমির সামনে একটি বড় গাছ বিদ্যুতের তারের ওপর পড়ে। এতে রেলপথ ও সড়ক দুটিই বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো শহর। চাঁদপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তা মোরশেদ হোসেন বলেন, বিকেলে ঝড়ের আঘাতে চাঁদপুর শহর ছাড়াও কচুয়া, শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলার সামনে এবং হাইমচরের একটি বসতঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইকোপার্কের পাশে ফেনী-পরশুরাম সড়কে গাছ পড়ে অভ্যন্তরীণ ও জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় গাছ অপসারণের পর আবার যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ছোট হরণ ও বড় হরণের মাঝামাঝি এলাকায় রেলপথের ওপর গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুই ঘণ্টা পর গাছ অপসারণ করে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করা হয়। এ সময় শহরের তালশহর রেলস্টেশন ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে কয়েকটি ট্রেন আটকা পড়ে।
ঝড়ের আঘাতে নোয়াখালী শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় একটি গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের লাইন ছিঁড়ে গেছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল বাহার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিভিন্ন স্থানে গাছের ঢালপালা পড়ে বিদ্যুৎ লাইনের তার ছিঁড়ে গেছে। এতে পুরো শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বরগুনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টিপাতের কারণে বরগুনার বিদ্যুৎ লাইনের ১৪৯টি স্থানে সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে পাঁচটি খুঁটি। ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তা মুহাম্মাদ আছফা উদ্দিন বলেন, ঝড়ে বরগুনা সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজকের মধ্যে সংযোগ মেরামত করার পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় গতকাল দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলায় প্রাথমিকভাবে ৩০টি কাঁচাঘর, দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘর বিধ্বস্তের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঝড়ের আঘাতে অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। নষ্ট হয়েছে আমন ফসল ও উঠতি শাকসবজি। হাতিয়া উপজেলার চতলার ঘাটে ২৫০ বস্তা ধানসহ একটি ট্রলার ডুবে গেছে। এ ছাড়া ডুবে গেছে ঘাটে থাকা একটি ড্রেজার। সেখানে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মো. হানিফ (৬০) নামের এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লকি বলেন, ঝড়ে তাঁর উপজেলায় কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ক্ষতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতায় জোয়ারের পানি বইতে দেখা গেছে।
সুবর্ণচরের ইউএনও মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বলেন, চর জব্বর ইউনিয়নের আবদুল মালেক উকিল বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চরবাটা ইউনিয়নের সওদাগর হাট উচ্চবিদ্যালয়ের টিনশেড ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। একই সময় ঝড়ো হাওয়ায় বিভিন্ন সড়কে বেশকিছু গাছ উপড়ে পড়েছে। খেতের পাকা ধান বেশির ভাগ শুয়ে গেছে। উঠতি শাকসবজি ক্ষতির মুখে পড়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে সুবর্ণচর উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার ২০টি ট্রলারের ৩০০ জেলের এখনো সন্ধান মেলেনি। ঝড়ের পূর্বাভাসের আগে তাঁরা সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ২০টি ট্রলারের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে কিছু ট্রলার সুন্দরবন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে বলে শুনেছেন।