দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। সংঘাত-সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ, নষ্ট হচ্ছে সম্পদ। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির বড় প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ব্যবসায়ীদের এক হিসাবে ৫ দিনের অবরোধে ক্ষতি হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মহামারি ও যুদ্ধের প্রভাব থেকে অর্থনীতি যখন মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনি হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকলে অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। করোনা পরবর্তী যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সংকট মোকাবিলা করছে দেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যুদ্ধও দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় আমদানিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “রাজনীতি যদি ঠিক না থাকে, তাহলে অর্থনীতি ঠিক থাকে না। পৃথিবীর যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে এবং রাষ্ট্র হিসেবে ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই গেছে। এখানে আমরা মনে করি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। রাজনীতি পরিচালনায় যে সহনশীলতা দরকার সেটা তারা দেখাতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন, “অবরোধ কর্মসূচি দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় বিনিয়োগসহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক-বীমা ও পুঁজিবাজারে। একইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থিক খাতগুলো ছাড়িয়ে শিক্ষাসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।”
তথ্য বলছে, গত ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপির ডাকা ৫ দিনের অবরোধে অন্তত ৩২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এছাড়া যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত ২৫ কোটি টাকা। অবরোধে পরিবহন চলাচল না করায় পণ্য পরিবহনে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। এছাড়াও কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলছেন তারা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে বলে শঙ্কা ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র।
সংগঠনটির সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, “অভ্যন্তরীণভাবে আমরা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ইমেজ তার চেয়েও বেশি নষ্ট হচ্ছে। কাস্টমাররা যাতায়াত করতে পারছেন না। এখন অর্ডার প্লেসমেন্টের সময়, তারা (কাস্টমার) মনে করেন রাজনীতির এই কর্মসূচি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে তাদের পণ্য পেতে অসুবিধা হতে পারে। ফলে যেটা হবে- সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাবে না, আর বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এতে লাভবান হবে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো। অবরোধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যঘাত ঘটলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। কেউ কেউ সুযোগও নিয়ে থাকে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও বাড়তে পারে।”
জানা গেছে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রপ্তানি খাত। রপ্তানির মাধ্যমে এখন যে পরিমাণ ডলার আসে, তা না আসা মানে রিজার্ভে টানাপোড়েনের টান আরও বেশি পড়া। এটাও বেশ উদ্বেগজনক। এছাড়াও উৎপাদনে ব্যবহৃত মূলধনি আমদানি কমে আসার প্রবণতাও শঙ্কা বাড়াচ্ছে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের।
সংবাদ প্রকাশকে দেওয়া এক তথ্য বলছে, মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলার আসে পণ্য রপ্তানি থেকে। অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি কমছে আগের অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশের মতো। মাসটিতে ৩৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। গত বছরের একই মাসের চেয়ে যা ৬০ কোটি ডলার কম। গড়ে প্রতিমাসে ৫০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এ হিসাবে অক্টোবরে ১২৪ কোটি ডলার কম রপ্তানি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির এই মন্দা পরিস্থিতিতে নতুন করে রপ্তানি কমায় রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই দায়ী করছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, গত কয়েক দিনের রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা অবরোধ কর্মসূচি পোশাক খাতকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। একইসঙ্গে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এমন অবস্থায় বিদেশি ক্রেতারা জানতে চেয়েছে আমদানির পরিস্থিতি কোন দিকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পোশাক শিল্পের মালিক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের সময় লাগছে। প্রথমে করোনা মহামারি, দ্বিতীয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর প্রধানত কারণ।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের রপ্তানি কমে যাচ্ছে। নতুন রপ্তানি আদেশ কম। এর মধ্যে বর্তমান রপ্তানি আদেশের ওপর মূল্যছাড় চেয়েছে কোনো কোনো ক্রেতা। আকাশপথে পণ্য পৌঁছাতেও চাপ দিচ্ছে কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। সাধারণত সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করা হয়। আকাশপথে পরিবহন খরচ সমুদ্রপথের চেয়ে অনেক বেশি।”
এদিকে বিরোধী দলগুলোর ডাকা অবরোধ কর্মসূচিতে যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় সংবাদ প্রকাশকে দেওয়া এক তথ্যে অন্তত ২৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হলেও এ বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে জানিয়েছেন পরিবহন নেতারা।
তারা বলছেন, অবরোধের এই কয়েক দিনে অনেক গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এছাড়াও পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে অনেক বাস। যেগুলো মেরামত করলেও চলাচলের উপযোগি করে তোলা সম্ভব নয়। পরিবহনের চাকা না ঘোরাতে অর্থ সংকটে পড়েছে মালিকেরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিবহন নেতা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “নির্বাচনের সময় কমে আসছে আর রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠছে। ক্ষমতার লোভে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পদ্ধতি কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পরিবহন খাত থেকে শুরু করে সবখানেই। ডাক দিচ্ছে হরতাল-অবরোধের, বন্ধ থাকছে সবকিছু। সড়কে পরিবহন নামলে ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হচ্ছে। তাই কেউই ভয়ে পরিবহন সড়কে নামাতে চাচ্ছে না। ফলে আর্থিক সংকট আরও বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হোক, অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়ুক এমন রাজনীতি দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে না। তাই দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে, অর্থনীতির নতুন সম্ভবনার কথা চিন্তা করে ক্ষতিকর কর্মসূচির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
ফায়ার সার্ভিসের এক তথ্য বলছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৯৪টি বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও মাইক্রোবাস ৩টি, প্রাইভেটকার ২টি, মোটরসাইকেল ৮টি, ট্রাক ১৩টি, কাভার্ডভ্যান ৮টি, অ্যাম্বুলেন্স ১টি, পিকআপ ২টি, সিএনজি ২টি, নছিমন ১টি, লেগুনা ১টি, ফায়ার সার্ভিস এর পানিবাহী গাড়ি ১টি, পুলিশের ১টি গাড়িতেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
অবরোধে কিছু সংখ্যাক পরিবহন সড়কে নামানোর ফলে যাত্রী সংকটে চাহিদা মতো ভাড়া না পাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এছাড়াও পরিবহন শ্রমিকদের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে বলে সংবাদ প্রকাশ জানান কয়েকজন পরিবহন চালক।
রাজধানীর নিউমার্কেট-আজিমপুর থেকে গাজীপুরগামী ভিআইপি বাসের এক চালক বলেন, “স্বাভাবিক দিনে যে পরিমাণ যাত্রী পাওয়া যায়, অবরোধে তার অর্ধেকও পাওয়া যায় না। অবরোধের দিন আমাদের যে ভাড়া উঠে তা দিয়ে চালানও দেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও আমাদের তো টাকা আছেই। আমরা যাত্রী না পেলে ভাড়া উঠাবো কি। ভাড়া উঠাতে না পারলে চালান দিমু কি আর পরিবার নিয়ে চলব কিভাবে।”