টানা দর পতনে নাস্তানাবুদ দেশের শেয়ারবাজার। রোববারও (২৭ অক্টোবর) ব্যাপক দর পতন হয়েছে। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে দর হারিয়েছে ৮৫ শতাংশ শেয়ার। এর মধ্যে ১৫৯ শেয়ার গতকালই ৫ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ দর হারিয়েছে। শুধু গতকালই নয়, গত আড়াই মাসে ২৯৬ শেয়ার কমপক্ষে ২০ থেকে ৭২ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে।
পুঁজি হারিয়ে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পুরোনো অফিস ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন।
দর পতনে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ অব্যাহতভাবে কমছে। গতকাল ঢাকার বাজারের প্রায় ৩০৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচাসহ সাকল্যে ৩১০ কোটি ৬৪ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন যা ছিল ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মনে করছে, চলতি দর পতন স্বাভাবিক নয়। কী কারণে দর পতন হচ্ছে, তা অনুসন্ধানে গতকালই সংস্থার অতিরিক্ত পরিচালক সামসুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে বিনিয়োগে আস্থা ফেরাতে করণীয় নির্ধারণে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে ১০ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির বিনিয়োগ বাড়াতে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম এ তথ্য জানিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে আইসিবির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পেতে সরকারি গ্যারান্টিপত্র দিতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দেশে ফেরার পরই এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ছাড় চেয়েছেন। বিশেষত চলতি অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মূলধনি মুনাফায় ২৫ শতাংশ হারে যে কর ধার্য করা হয়েছে, তা অন্তত এ বছরের জন্য প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান এ করহার যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন।
তবে এ আশ্বাস পাওয়ার দিনে ঢাকার শেয়ারবাজার ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯৭ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৯৪টির কেনাবেচা হয়েছে, যার ৩৩৯টিই দর হারিয়েছে। লেনদেনের মাঝে অন্তত ৬৩ কোম্পানির শেয়ার সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে কেনাবেচা হয়েছে এবং ক্রেতাশূন্য অবস্থায় পড়েছিল।
সিংহভাগ শেয়ার দর হারানোয় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ পয়েন্ট হারিয়ে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর এই প্রথম ৫০০০ পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমেছে। সূচকের সর্বশেষ অবস্থা ছিল ৪৯৬৫ পয়েন্টে, যা আগের কর্মদিবসের তুলনায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশ কম।
পতনের হার বিবেচনায় এটা ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল বা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই দিন সূচক ১৮১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারিয়ে ৫০৮৯ পয়েন্টে নেমেছিল। তবে পয়েন্ট বিবেচনায় সূচকের এ পতন ২০২২ সালের ৭ মার্চের পর সর্বোচ্চ। ওই দিনের সূচক ১৮২ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারিয়ে ৬৪৫৬ পয়েন্টে নেমেছিল।
দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) ব্যাপক দর পতন হয়েছে।
চলতি দরপতনের জন্য শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে দায়ী করছেন বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। মতিঝিলে বিক্ষোভের সময় তারা দাবি করেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা পদক্ষেপের কারণে দরপতন হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, স্বল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক জরিমানা, তদন্ত করার কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে বাজার ছাড়ছেন। এরই মধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা না করা এবং লভ্যাংশ ঘোষণার পরও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ না করার দায়ে ২৭টি কোম্পানির শেয়ারকে ‘জেড’ ক্যাটেগরিভুক্ত করা হয়েছে। এসব কারণে শেয়ারগুলো দর হারিয়েছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন বিক্ষুদ্ধ বিনিয়োগকারীরা।
তবে বিনিয়োগকারীদের এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন বিএসইসির মুখপাত্র। তিনি সমকালকে বলেন, জরিমানা বা তদন্ত করা হয় কারসাজি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য, সুশাসন ফেরানোর জন্য। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। বর্তমান কমিশন এ কাজ থেকে পিছপা হবে না। কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কথা স্বীকার করে রেজাউল করিম বলেন, গত কিছুদিন ধরে ব্যাপক দরপতন হচ্ছে। এ দরপতনের জন্য ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার দায়ী বলে বিশ্লেষকরাই মত দিচ্ছেন। এসব কারণে বিত্তশালী বিনিয়োগকারীদের অনেকে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংকে আমানত রাখা বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করাকে পছন্দ করেন। এ কারণে বাজারে বিনিয়োগ চাহিদা কমছে। এসব সমস্যার সমাধান বিএসইসির হাতে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ফেরার পর শিগগির নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয় সভা আহ্বানের অনুরোধ করা হবে। ওই সভায় ব্যাংকের সুদহারসহ অন্যান্য বিষয় কীভাবে শেয়ারবাজারবান্ধব করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজে দেখা হবে বলে জানান বিএসইসির মুখপাত্র।
এনবিআর চেয়ারম্যানের সহায়তা কামনা
ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গতকাল এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সঙ্গে আগারগাঁওয়ে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করেন।
ডিএসইর প্রতিনিধিরা শেয়ারজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নীতিসহায়তার জন্য অনুরোধ জানান। বিশেষ করে চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মূলধনি মুনাফা ৫০ লাখ টাকার অধিক হলে আরোপিত কর প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন।
এর কারণ ব্যাখ্যায় প্রতিনিধি দল জানায়, আয়কর আইনের অর্জিত ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি আয়ের ওপর কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়। এতে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ হারে কর প্রদানকারী করদাতাদের জন্য সারচার্জসহ এরূপ অর্জিত আয়ের ক্ষেত্র বিশেষে সাড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়, যা ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারবিমুখ করেছে। ফলে ডিএসইতে দৈনিক লেনদেন গত ফেব্রুয়ারির সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ক্রমাগত কমে অক্টোবরে ৩০০ কোটি টাকায় নেমেছে। বাজারের সূচকও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং সূচকের অব্যাহত পতন বিনিয়োগকারীদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
লিখিত প্রস্তাবে ডিএসইর চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, বিভিন্ন অনিয়ম এবং নীতি অসংগতির কারণে দেশের শেয়ারবাজার অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে এ বাজারের কাঠামোগত সংস্কারে সরকার, বিএসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জসহ সব বাজার মধ্যস্থাকারি প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে।
ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ আয়ের ওপর উৎসে কর্তিত করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেন থেকে শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ উৎসে কর কমিয়ে অন্য খাতের আয়ের সঙ্গে সমন্বয় কিংবা নিরূপিত ক্ষতির জের পরবর্তী ছয় বছর পর্যন্ত টানার অনুমতি চাওয়া হয়। এনবিআর চেয়ারম্যান প্রস্তাবনাগুলোর ব্যাপারে শিগগির সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশ্বাস দেন।