• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বপ্নের সঙ্গে শেষ সম্পদও


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুন ১, ২০২৪, ০৯:৫৮ পিএম
মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বপ্নের সঙ্গে শেষ সম্পদও
এভাবেই অপেক্ষা করছিলেন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা। ছবি : সংগৃহীত

রাত তখন প্রায় ১০টা। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১-এর বাইরে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের জটলা। কেউ ছুটোছুটি করছে, কেউবা অশ্রুসিক্ত চোখে মোবাইলে কথা বলছে। সবার চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। ভাঙা হৃদয়ে হাতে পাসপোর্ট ধরে বিমানবন্দরের ফ্লোরে বসে আছেন। কেউ মাথায় হাত দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় অনেকে স্তব্ধ। শেষ দিন শুক্রবার (৩১ মে) মালয়েশিয়ায় যেতে না পারায় এক নিমিষেই ভেঙে গেছে ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মীর স্বপ্ন।

আবু সাঈদ নামের এক যাত্রী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “জীবনের সব স্বপ্ন শেষ। ভেবেছিলাম প্রবাসে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু করতে পারব। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। উল্টো জীবনটা আরও ভেঙে গেল। অন্ধকার নেমে এলো। একদিকে মালয়েশিয়ায় তো যেতে পারলাম না, অন্যদিকে প্রায় ৬ লাখ টাকা জমা দিয়ে এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না।”

আবু সাঈদ আরও বলেন, “শুক্রবার দুপুরে বিমানবন্দরে এসেছি। দালাল বিকেলের মধ্যে বিমানের টিকিট দিবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু সেই কথা তারা রাখেনি। কয়েকশ ফোন দিয়েছি, তারা একবারও রিসিভ করেননি। সারা রাত বিমানবন্দরের ফ্লোরে কেটে দিয়েছি। ভেবেছিলাম সরকার আমাদের দিকে তাকাবে। সকাল পর্যন্ত কেউ আমাদের দিকে তাকায়নি। বাড়িতে ছোট ছোট সন্তান। ঋণ নিয়ে সংসার কীভাবে চালাব, আল্লাহ ভালো জানেন। জীবনে আর কিছুই রইল না।”

রায়হান নামের আরেক যাত্রী বলেন, “জীবন নিয়ে অনেক আশা করেছিলাম। এখন আর কিছু নেই। মানুষের কাছে থেকে লোন নিয়ে দালালকে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো বিদেশ যেতে পারলাম না। বাড়ি গিয়ে পাওয়ানারদের কীভাবে মুখ দেখাব। কিস্তি আর সংসার কীভাবে চালাব। আমার আর কিছু রইল না। জমিজমাও নাই যে বিক্রি করে ধারদেনা পরিশোধ করব। সব শেষ হয়ে গেল।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারিভাবে যারা মালয়েশিয়ায় ওয়ার্কার ভিসা (কর্মী ভিসা) পেয়েছেন তাদের ৩১ মের মধ্যে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিল দেশটির সরকার। এরপর আর কোনো নতুন বিদেশি কর্মী দেশটিতে ঢুকতে পারবেন না।

গত ১৬ মে পত্রিকায় জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি সবাইকে জানায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অনেক প্রবাসী এ কথা জানতেন না। ২০ মের পর বিষয়টি জানাজানি হলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে। এতে ফ্লাইটের সংকট দেখা দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে ৩১ মে সময়সীমার কারণে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো আসন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। তবুও চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বিমানবন্দরেই রয়ে যায় ত্রিশ হাজারের বেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জুলাইয়ে নতুন করে চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি মালয়েশিয়া গেছেন। কর্মী পাঠানো নিয়ে অনিয়ম, দেশটিতে গিয়ে কর্মীদের চাকরি না পাওয়া ও শ্রম শোষণের অভিযোগ করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ কারণে আবারও শ্রমবাজার বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুরের পর থেকেই মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা ভিড় করতে থাকেন বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১-এ। এরপর সন্ধ্যা থেকে রাত যত গভীর হয় ততই যাত্রীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে আশেপাশের পরিবেশ। ফ্লাইট শিডিউলের ডিসপ্লেতে এক পানে চেয়ে থেকেও টিকিট না পেয়ে অশ্রুভেঁজা চোখ নিয়ে ফ্লোরেই রাত পার করে দেন তারা। কেউ মাথার নিচে ব্যাগ রেখে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়েন, কেউবা সবকিছু হারিয়ে একাকিত্ব হয়ে এক কোণায় বসে থাকতে দেখা যায় অনেককেই।

শুধু সারা রাত নয়, রাত পেরিয়ে সকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও অনেক যাত্রী ফ্লাইটের আশায় চেয়েছিলেন সরকারের দিকে। তবে কোনোদিক থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় বিমানবন্দরেই পার করে দিয়েছেন পুরো ২৪ ঘণ্টা। ভবিষ্যৎ নিয়ে পুষে রাখা সব স্বপ্ন হারিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া কিছুই নেই তাদের। কান্না করতে করতে চোখ ফুলে গেছে অনেক যাত্রীরা।

ভুক্তভোগীরা জানান, বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির দালালদের কথায় টিকিট ছাড়াই শুক্রবার ভোর থেকে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেন যাত্রীরা। দ্বিগুণ মূল্যে টিকিটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় দালালরা। ফলে অনিশ্চয়তা নিয়ে শনিবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন কয়েক হাজার যাত্রী। তবে শেষমেষ কোনো সাড়া না পাওয়ায় বিমানবন্দর ছেড়েছে তারা।

ঋণ করে ৬ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাজশাহীর যুবক আবুল খায়ের। কথা ছিল শুক্রবার রাত ১২টা ৪০ মিনিটে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। টিকিট দিবেন সন্ধ্যার মধ্যে। কথামতো বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তবে শেষমেষ টিকিট তো দূরের কথা দালাল দেখাও করতে আসেনি আবুল খায়েরের সাথে। মধ্যরাতে মালয়েশিয়া এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট ঠিকই ঢাকা বিমানবন্দর ছেড়েছে, কিন্তু আবুল খায়ের যেতে পারেনি।

আবুল খায়ের বলেন, “এক মাসের কথা বলে সম্প্রতি ঋণ করেছি ৩ লাখ টাকা। মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ পেয়ে ব্যাংক থেকে লোন করে পরিশোধ করব, এমন প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় টিকিট না পেয়ে সারা রাত বিমানবন্দরেই কাটিয়ে দিয়েছি। এতগুলো টাকার ঋণ কীভাবে পরিশোধ করব। সামনে ঈদ আসছে সবাই আমাকে ভরসা করে টাকা দিয়েছিল। তাদের টাকা কীভাবে পরিশোধ করব, ভেবে পাচ্ছি না।”

শান্ত নামের আরেক যাত্রী বলেন, “জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছি দালালের কাছে। এখন বিদেশ যেতে পারিনি। জমিও গেল টাকাও গেল। স্বাভাবিক জীবনে এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ করব, বিশেষ ফ্লাইটে যেন তিন দিনের মধ্যে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। নয় তো মানসিক অশান্তিতে অনেকেই স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের পথ বেঁচে নিতে হবে।”

আকাশ নামের এক যাত্রী বলেন, “সিন্ডিকেটের বলি আমরা। আমরা জানতাম না ৩১ মের পর আর কোনো ফ্লাইট চলবে না মালয়েশিয়ায়। দালাল আমাদের কাছে এ তথ্য গোপন করেছেন। এখন যেতে পারলাম না। পরিবারের কাছে কীভাবে মুখ দেখাব। লোন আর কিস্তির চাপে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।”

তথ্য বলছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মালয়েশিয়াগামী বাড়তি একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

বিমানের কর্মকর্তারা জানান, বিজি ৩০৮২ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বেবিচক থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। রাত ৮টায় বিমানবন্দর থেকে ২৭১ জন যাত্রী নিয়ে বিমানের বাড়তি এ ফ্লাইটটি মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

Link copied!