• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জিহাদ দেখালেন কীভাবে আজিমকে খুন করেন তারা


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
জিহাদ দেখালেন কীভাবে আজিমকে খুন করেন তারা
জিহাদ দেখাল কীভাবে আজিমকে খুন করে তারা

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম হত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের হেফাজতে থাকা জিহাদ হাওলাদারকে দিয়ে পরিকল্পনা করানো হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানতে পেরেছে, আজিমের পোশাক, মোবাইল ফোন কোথায় ফেলা হয়েছিল এবং দেহ থেকে খুলি আলাদা করে টুকরো করার পরে কোথায় ফেলে দিয়েছিলেন হত্যাকারীরা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, যে তাদের সামনেই সোমবার জিহাদ সংসদ সদস্য আজিমকে কীভাবে হত্যা করা হয়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন।

ডিবিপ্রধান বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি তাকে সোমবার ঘটনার বিবরণ জানানোর জন্য ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেখানে ছিলাম।”

পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “ওই ফ্ল্যাটে যখন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিল জিহাদ, তার সঙ্গে ঢাকায় ধৃত আমানুল্লাহসহ অন্যদের বয়ানে কিছু অসঙ্গতি পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকেই একাধিকবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা আর কলকাতায় ধৃতদের মুখোমুখি জেরাও করা হয়।”

সোমবার (২৭ মে) সিআইডি-র গোয়েন্দা এবং ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তার সামনে জিহাদ বর্ণনা দেন কীভাবে তারা আনোয়ারুল আজীমকে এই ভবনের এক ফ্ল্যাটে হত্যা করে লাশ গুম করেছিল।

এর আগে, রোববার কলকাতায় এসে সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হেফাজতে থাকা অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদকে নিজে জেরা করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

গ্রেপ্তার জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দপ্তর ভবানী ভবনে রাখা হয়েছে, সেখানেই চলে এই জেরা। তার আগে ঢাকা থেকে ডিবির একটি দল গিয়েছিলেন নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে, যেখানে হত্যা করা হয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে। দুই জায়গা থেকেই একাধিকবার ঢাকায় গ্রেপ্তারদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন ডিবিপ্রধানকে।

জিহাদ সোমবার ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে, তার ওপর ভিত্তি করে জানা যাচ্ছে যে ১৩ মে দুপুর তিনটে নাগাদ দুই অভিযুক্ত ফয়সাল এবং আমানুল্লাহর সঙ্গে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন আজিম। ওই ফ্ল্যাটটি ডুপ্লেক্স, অর্থাৎ ফ্ল্যাট হলেও তার ভেতরেই দুটি তলা রয়েছে।

দুই অভিযুক্ত আজিমকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার সময়ে তৃতীয় অভিযুক্ত শেলেস্তি রহমান ওপরের তলায় ছিল, আর নিচের অংশেরই ভেতরের একটি ঘরে ছিল জিহাদ এবং সিয়াম।

জিহাদ পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হাতে ধরা পড়লেও সিয়াম পলাতক। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন তিনি সম্ভবত নেপালে পালিয়েছেন।

জিহাদের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ফ্ল্যাটে প্রবেশের পরেই ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড় আজিমের মুখে চেপে ধরা হয় এবং তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় ফ্ল্যাটের রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায়।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, “ফ্ল্যাটের যে হলঘর, অর্থাৎ বসার এবং খাওয়ার জায়গা, সেখানে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেটি খুনের আগে, ৭ মে দুপুর নাগাদ শেলেস্তি রহমান কাপড় আর লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ঢেকে দেন।”

অভিজাত ফ্ল্যাটগুলোতে সাধারণত ঘরের কাজ করেন যারা, তাদের ওপরে নজরদারির জন্য এ ধরনের সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। সেই সিসিটিভি-র ফুটেজ কার কাছে আছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

হত্যার পরে কীভাবে দেহ লোপাট হবে, তাও আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বলে গ্রেপ্তাররা আগেই ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েছিল।

সোমবার জিহাদ পুলিশের কাছে যে বর্ণনা দিয়েছে, তাতে জানা যাচ্ছে যে রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায় হত্যা করার পরে জিহাদ আজিমের দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয় ও হাড় এবং মাংস পৃথক করে ফেলে। শরীর থেকে কেটে ফেলা হয় মাথাও। দেহের মাংস আর মাথার খুলি টুকরোও করে জিহাদই।

এই কাজে জিহাদ চপার জাতীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বলে সিআইডিকে জানিয়েছে। ওই অস্ত্র স্থানীয়ভাবে কিনে এনেছিল আমানুল্লাহ। দেহের টুকরোগুলো ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়।

ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, “আমরা ওই বাড়িতে দাঁড়িয়ে বর্ণনা শুনলাম যে কীভাবে মাননীয় সংসদ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যা করা হয়নি, লাশটাকে যাতে গুম করা যায়, তার জন্য শুনলাম কীভাবে শরীর থেকে মাংস আলাদা করা হয়েছে।”

“একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে আমি ওই বর্ণনা শুনে মানতে পারছিলাম না যে এতটা নিষ্ঠুর, এত পাষাণ তারা!” বলছিলেন ডিবিপ্রধান।

জিহাদের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে তিনজনই বাইরে জুতো রাখার ক্যাবিনেটে নিজেদের জুতো খুলে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের প্রবেশপথে নজরদারি রাখার জন্য যে সিসিটিভি আছে, তার ফুটেজ থেকে তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছিলেন যে ১৩ মে বিকেল ৪টা নাগাদ তারা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে জুতোগুলো ভেতরে সরিয়ে নিচ্ছে। জিহাদ সোমবার সেই ঘটনারও বর্ণনা দিয়েছে।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, “ঘটনার পরিকল্পনার সময়ে জিহাদ জানিয়েছে যে সে আজীমের টুকরো করা দেহাংশ ভর্তি প্যাকেটগুলো নিয়ে রওনা হয় ভাঙ্গরের কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে। তার সঙ্গে আরও ছিল দেহ টুকরো করার অস্ত্র এবং আনোয়ারুল আজিমের পোশাক এবং মোবাইল।

তিনি আরও বলেন, “মোবাইল এবং মি. আজীমের পোশাক সে ফেলে দেয় নিউ টাউন থেকে কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে যাওয়ার পথে গাবতলা বাজার নামে একটি জায়গায়। সেখানেও বাগজোলা খালই বইছে, বলছিলেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

জিহাদ জানিয়েছেন, সেখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে একটি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে নিচে নেমে দেহাংশ ভরা প্যাকেটগুলো খালের জলে ফেলে দেন তিনি। সঙ্গে দেহ টুকরো করার কাজে ব্যবহৃত চপারটিও।

ওই জায়গাতেই তিন দিন ধরে ডুবুরি আর নৌকা নামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিআইডি।

সোমবার সেখানেও গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ডিবিপ্রধানসহ পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির একটি দল।

সেখানে সাংবাদিকদের ডিবিপ্রধান জানান, “জিহাদকে নিয়ে আমরা খালের পাড়ে এসেছি। কোন জায়গায় তারা লাশটাকে ফেলেছিল সেটা আমরা দেখছি। কীভাবে এটা উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে আমরা মিটিংও করেছি। আমরা মনে করি দ্রুতই আমরা দেহ অথবা দেহের অংশবিশেষ আমরা উদ্ধার করতে পারব।”

সূত্র : বিবিসি

Link copied!