বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে৷ বেড়েছে ডিম আর মুরগির দাম৷ পেঁয়াজের দামও বেড়েছে৷ কিছু সবজির দাম কমলেও কোনো কোনো সবজির দাম আবার বেড়ে যাচ্ছে৷ তবে ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল আছে৷
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও সিন্ডিকেট আর চাঁদাবাজরা ভোল পালটে আবার সক্রিয় হয়েছে৷ এক ব্যবসায়ী নেতা বললেন, “আগে বলত জয় বঙ্গবন্ধু, এখন বলে জয় ইউনূস৷”
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল৷ কিন্তু এখন আবার বাড়ছে৷ এর কারণ বাজারের পুরোনো খেলোয়াড়রা আবার সক্রিয় হয়েছে৷’
এদিকে, ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘এখন আবার আগের অবস্থায় চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেট ফিরে এসেছে৷ শুধুমাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতবদল হয়েছে৷’
গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে পাঁচ-ছয় টাকা৷ এক সপ্তাহ আগে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৪ টাকা, এখন তার দাম ৫২ থেকে ৬০ টাকা৷ মিনিকেট চালের দামও কেজিতে ছয় টাকা বেড়েছে৷
আলু আর পেঁয়াজের দাম কয়েক মাস ধরেই বেশি৷ আলুর কেজি এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা৷ দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি৷ আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে৷ এছাড়া আলু আমদানিতে থাকা তিন শতাংশ এবং পেঁয়াজ আমদানিতে থাকা ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ তারপরও কমছে না এই দুইটি পণ্যের দাম৷
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, “চালের দাম কেন বাড়ছে জিজ্ঞেস করলে ব্যবসায়ীরা আপনাকে বলবে বাজারে ধান কম, তাই তাই চালের দাম বেড়েছে৷ বন্যার কথাও বলবে তারা৷ কিন্তু আসল ঘটনা অন্য জায়গায়৷ এখন বাজারে ধান কম থাকলেও ধান আছে উত্তরাঞ্চলের চাতাল মালিকদের কাছে৷ তারা আগেই ধান কিনে স্টক করে রেখেছে৷ এখন তারা সুযোগ পেয়ে দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে৷ সর্বোচ্চ ৩০ জন চাতাল মালিক এটা নিয়ন্ত্রণ করছে “
তিনি আরও বলেন, “তারা সরকার পতনের পর কয়েকদিন ভয়ে সক্রিয় হয়নি৷ তখন চালের দাম বাড়েনি৷ কিন্তু এখন তারা আবার সক্রিয় হয়েছে৷ তারা আগে ছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্রের লোক, এখন তারা ভোল পালটে নতুনদের লোক হয়ে সিন্ডিকেট শুরু করেছে৷ আগে বলতো জয় বঙ্গবন্ধু, এখন বলে জয় ইউনূস৷”
চালের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নতুন ধান উঠতে আরও এক দেড়-মাস লাগবে৷ এই সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে চালের বাজার আরো অস্থির হতে পারে৷”
ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে৷ দুই সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৭০ টাকা, যা এখন ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে৷ কোথাও কোথাও ব্রয়লারের দাম আরো বেশি৷ সোনালি মুরগির দামও কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ২৬০ টাকা হয়েছে৷ ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দাম ডজনপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়েছে৷ প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা দরে৷ আর ফার্মের মুরগির সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ডজন ১৫০ টাকা দরে৷ এখনেও পাঁচ টাকা বেড়েছে৷
অধিকাংশ সবজির দাম কিছুটা কমলেও বাড়ছে কাঁচমরিচের দাম৷
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, “মুরগি আর ডিমের দাম নির্ভর করে পোল্ট্রি ফিডের ওপর৷ মোট উৎপাদন খরচের ৭০ ভাগই ফিডের দাম৷ ফিডের দাম কমেনি৷ আগে যা ছিল, তা-ই আছে৷ এই ফিড উচ্চমূল্যের জন্য সরকারের নীতি ও সিন্ডিকেট দায়ী৷ এরপরও দাম কমার কথা৷ কিন্তু সেটা কমছে না করপোরেটদের কারণে৷ তারা ডিম ও মুরগির দাম এখনো সিন্ডিকেট করে ঠিক করছে৷ মাত্র কয়েকজন ব্যবসায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ সরকারের পতনের পর কয়েকদিন তারা কিছুটা দমে গেলেও এখন আবার সক্রিয় হয়েছে৷ আর বন্যার কারণে অনেক খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷”
চাষের মাছের দাম স্থিতিশীল থাকলে ভারতে রপ্তানি বন্ধ ও ইলিশের মৌসুম হলেও ইলিশের দাম এখনো চড়া৷এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকায়৷ ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা৷ আর ৫০০ থেবে ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের জন্য গুণতে হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা থেকেএক হাজার ৩০০ টাকা৷
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সরকার পতনের পর নিত্যপণ্যের দাম কমেছিল৷ তখন চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছিল৷ কিন্তু এখন আবার দাম বাড়ছে৷ কারণ, বাজারে আবার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজরা ফিরে এসেছে৷ পুলিশসহ প্রশাসনে ঢিলেঢালা ভাব৷ পুলিশের অভাবে অভিযান হচ্ছে না৷ম্যাজিষ্ট্রেটও পাওয়া যাচ্ছে না ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায়৷ ফলে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না৷ সরকার যদি বাজার মনিটরিংয়ে নজর দেয়, আইনের কঠোর প্রয়োগ করে, তাহলে দাম বাড়ার সুযোগ নেই৷ সরকারকে এই দিকে নজর দিতে হবে৷”
তার কথা, “বাজার নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়৷ কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন মাঠ পুরোপুরি প্রস্তুত৷ দেরি করলে আবার পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে৷”
আর ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “আমি নিজে কারওয়ান বাজারসহ আরো কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখেছি৷ তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে চাঁদবাজি, সিন্ডিকেট কয়েকদিন না থাকলেও এখন আবার শুরু হয়েছে৷ এটা হাতবদল হয়েছে৷ পরিস্থিতি আগের মতোই, শুধু নতুন গ্রুপ এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে৷ ফলে নিত্য পণ্যের দাম বাড়ছে৷”
তিনি আরও বলেন, “এর সঙ্গে বন্যার একটা প্রভাব আছে৷ কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কমেছে৷ কিছু পণ্যে ‘ডিউটি` কমেছে৷ এর ইতিবাচক প্রভাব তো বাজারে পড়া উচিত, কিন্তু পড়ছে না৷ বাজারকে অস্থির করতে এক গ্রুপ ব্যবসায়ী আবার সক্রিয় হচ্ছে৷ তারা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে৷”