জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধাচারণ গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লার জন্য শাপে বর হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এবং মনোনয়ন জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেছে। মনোনয়ন বাতিল হোক বা গৃহীত হোক সেটা বড় বিষয় নয়, তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত এবং তার কিছু বক্তব্য গাজীপুর আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র বিতর্ক তৈরি করেছে। এমনকি যারা বিভিন্ন সময়ে জাহাঙ্গীরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন, যারা আজমত উল্লার বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরকে পাদপ্রদীপে আনার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, তারা পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এ কারণেই এখন জাহাঙ্গীর গাজীপুর আওয়ামী লীগে একঘরে হয়ে পড়েছেন। তার মুষ্টিমেয় কিছু সমর্থক, তল্পিবাহক গোষ্ঠী ছাড়া কোনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জাহাঙ্গীরের পক্ষে নেই। তবে দলীয় নেতাকর্মী ও গাসিকবাসি এখন জাহাঙ্গীরে চরম ক্ষুব্ধ আর আজমত উল্লার পক্ষে একাট্টা হয়ে নৌকারে বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছেন।
গাসিকে ঐক্যবদ্ধ প্রচারণায় আ.লীগ
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও মাঠে রয়েছেন তার মা জাহেদা খাতুন। এ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান।
এ নির্বাচনের প্রধান সমন্বায়ক ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, “জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচন, দেশবাসীর জন্য ও আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হওয়ার জন্য কাজ করতে হবে।”
এর আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন জাহাঙ্গীরকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “জাহাঙ্গীর যদি শেষ পর্যন্ত আজমত উল্লার পক্ষে কাজ না করেন তাহলে তাকে আজীবন বহিষ্কার করা হবে।”
দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলেই এসএম কামাল এরকম বক্তব্য দিয়েছেন। শুধু এসএম কামাল নয়, আওয়ামী লীগের সমস্ত নীতিনির্ধারক নেতারা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আর তা বুঝতে পেরেছেন গাজীপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা এখন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথাবার্তা বলা থেকেও বিরত থাকছেন বলে জানা গেছে। এতে জাহাঙ্গীর দৃশ্যত একা হয়ে গেছেন।
গাসিক নির্বাচনে যা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা
২০১৩ নির্বাচনে আজমত উল্লা বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এইসময় জাহাঙ্গীরসহ আওয়ামী লীগের একটি অংশ আজমত উল্লার বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করেছিল এবং আওয়ামী লীগের এই বিভক্তির কারণে শেষ পর্যন্ত আজমত উল্লা পরাজিত হয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
২০১৮ নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার পৃষ্ঠপোষকতা পান এবং তার মনোনয়ন লাভ অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। এই মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর আজমত উল্লা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরের বিভিন্ন অপমান এবং লাঞ্ছনা সহ্য করেও দলের স্বার্থে গাজীপুর আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর মেয়র হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ওপর বিরূপ আচরণ শুরু করেন। দলের যারা ত্যাগী পরীক্ষিত তাদের বাদ দিয়ে একটি বিকল্প আওয়ামী লীগ গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার টাকার কারণে নব্য আওয়ামী লীগারদের দাপট বেড়ে যায় গাজীপুরে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে অসৌজন্যমূলক বক্তব্যের কারণে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি মেয়র পদ হারান। এরকম পরিস্থিতিতে এবারের নির্বাচনে জাহাঙ্গীর যে মনোনয়ন পাবেন না তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। যদিও কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় যারা দলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা মানে এই নয় যে তিনি আবার নির্বাচনের মনোনয়ন পাবেন। বরং জাহাঙ্গীর যদি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আজমত উল্লার পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করতেন বা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও থাকতেন, তাহলে তার এই পরিণত হতো না।
জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সিদ্ধান্ত হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করছেন এবং তার কিছু কিছু বক্তব্য ধৃষ্টতাপূর্ণ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এর প্রেক্ষাপটেই এখন জাহাঙ্গীর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের। ফলে গাজীপুরে গত এক দশকের মধ্যে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় আছে এবং এই অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে আজমত উল্লা গাজীপুরের নির্বাচনে সহজ জয় পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী
গাজীপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতায় যাবে না। জাহাঙ্গীর আলমের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডগুলোর পুরো বিবরণ ওয়াশিংটনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং তার সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা না করার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করায় তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারান। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকেও দুর্নীতির দায়ে অপসারণ করে। এরপর থেকে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের কেউ নন।
সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের আগে বিভক্তি দূর করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যারা বিদ্রোহী হয়েছিলেন এবং অপরাধ করেছিলেন তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় জাহাঙ্গীর ক্ষমা প্রার্থনা করে দলের সভাপতির কাছে আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার ওপর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে তিনি কোনো পদ পদবি পাননি। এবার মনোনয়নের সময় জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরের ওপর আস্থা রাখেনি দল বরং দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা আজমত উল্লাহকে মনোনয়ন দিয়েছে। এটি জাহাঙ্গীর মেনে নিতে পারেননি।
দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে জাহাঙ্গীর এবং তার মা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন বাছাইয়ের সময় জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপি থাকার অভিযোগ উত্থাপন করে। যদিও তিনি এই অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করেছেন।
ঋণ খেলাপির অভিযোগের বিরুদ্ধে তিনি এমন সব মন্তব্য করেছেন, যেগুলো দল এবং নির্বাচন কমিশনের স্বার্থের পরিপন্থি। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পূর্ণ বিবরণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে গেছে। প্রধানমন্ত্রী সব জেনেছেন।
সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগের বিষয়ে জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বলেছেন, একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে ফোন করে অনুরোধ করেন তাহলে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। তার আলোচনার দরজা সব সময় খোলা রয়েছে। জাহাঙ্গীরের এ ধরনের বক্তব্যকে ধৃষ্টতা মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।