নানা নাটকীয়তা, রাজনৈতিক টানপোড়েন শেষে সম্পন্ন হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। দুএকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবেই শেষ হয়েছে নির্বাচন।কমিশন জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এমন ভোটের হারে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বেসরকারি ফলাফলে আওয়ামী লীগ ও শরীক দল ২২৪ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাই আওয়ামী শিবিরে ফুরফুরে ভাব বিরাজ করছে। তবে কপাল পুড়েছে জাতীয় পার্টির।
এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের) সরকারি দল থেকে প্রতিশ্রুত ২৬টি আসনে ছাড় পেলেও দলটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে মাত্র ১১টিতে। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের নির্বাচনের দিন শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন- জাতীয় পার্টিকে কৌশলে নির্বাচনে এনে কোরবানি দেওয়া হবে। নির্বাচনে প্রতিশ্রুত আসনগুলিতে জয় না পেয়ে দলটির অনেক নেতা-কর্মীই এখন মনে করছেন দলের চেয়ারম্যানের ‘কোরবানি’র আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২৩টি আসন। ২৩ থেকে এখন নেমে এল ১১তে।
দ্বাদশ নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কম নাটকীয়তা হয়নি। শেষে অনেক দেনদরবারের পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়েছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন এই জাতীয় পার্টি (জাপা)। সব মিলে এবার ২৬৫টি আসনে তাদের প্রার্থী ছিল।
সেই ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জিতেছেন জাপার প্রার্থীরা। কিন্তু সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে দলের প্রার্থী জিততে পারেননি। এমনকি সমঝোতায় পাওয়া ঢাকা-১৮ আসনেও হেরে যান জাপা প্রার্থী ও জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদের। জামানতও হারান তিনি।
বর্তমানে দলটির ২৩ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য রয়েছেন চারজন। দ্বাদশ নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা কমে গেল।
বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার জয়ী হয়েছেন।
এই চার জ্যেষ্ঠ নেতার বাইরে প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), গোলাম কিবরিয়া (বরিশাল-৩), এ কে এম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), মো. আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১) ও শরিফুল ইসলাম (বগুড়া-২) নির্বাচিত হয়েছেন।
একাদশ সংসদের ২৩ জন সদস্যের মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ আবু হোসেন, গাইবান্ধায় শামীম হায়দার পাটোয়ারি, ময়মনসিংহে ফখরুল ইমাম, সুনামগঞ্জে পীর ফজলুর রহমান, কুড়িগ্রামে পনির উদ্দিন আহমেদ, নীলফামারীতে আহসান আদেলুর রহমান ও রানা মোহাম্মদ সোহেল, বগুড়ায় শরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জে লিয়াকত হোসেন, বরিশালে নাসরিন জাহান, বগুড়ায় নুরুল ইসলাম তালুকদারসহ ১৪ জন সংসদ সদস্য এবার পরাজিত হয়েছেন।
এর বাইরে দল থেকে বাদ পড়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা ও রুস্তম আলী ফরাজি। তারাও জিততে পারেননি।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপাকে ৩৩টি আসন দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপা ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয়। এবার দলটি গতবারের চেয়ে অর্ধেক আসন কম পেল।
এবার জাপা তাদের ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জন প্রার্থী নিজে থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের পর ২৬৫ জন প্রার্থী টিকে থাকেন। তবে নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ১৯ জন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিলেন ২৪৬ জন। কিন্তু অনেকেই প্রচারণায় ছিলেন না।
নির্বাচনে জাপার এমন ভরাডুবি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। বিশেষ করে সংসদে তাদের অবস্থান কী হবে। তারা কি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হবে?
কারণ এবার আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন, তারা জাপার চেয়ে অনেক বেশি আসনে জিতেছেন। এসব নিয়ে চলছে নানা মুখরোচক আলোচনা। অনেকে জিএম কাদেরের ‘কোরকবানি’ তত্বকে আলোচনার বিষয়বস্তু বানিয়ে চায়ের টেবিলে ঝড় তুলছেন।