আগামী মে মাসে মেয়াদ শেষ হচ্ছে চার বছরের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের। করোনা মহামারির কারণে শেয়ারবাজারে যখন বড় ধরনের ধস নামে, সেই কঠিন সময়ে বিএসইসির হাল ধরে শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরুসহ বেশি কয়েকটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে এই কমিশন। তবে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে ঘন ঘন শেয়ারবাজারের দরপতনে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজারে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এটি ছিল একটি সামগ্রিক ব্যর্থতা। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন এবং অনেকে আত্মহননের পথও বেঁচে নিয়েছেন। তাদের অপরাধ ছিল, তারা দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। শেয়ারবাজার নীতি নির্ধারণী মহল থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না।
জানতে চাইলে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সোহেল রানা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বিনিয়োগ করতে হবে মৌলভিত্তিক। আমাদের দেশে বিনিয়োগের একটা পলিসি আছে। যেমন, একজন বলছেন তার কথা শুনে আরেকজন বিনিয়োগ করছেন। এই প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। ইনভেস্ট পলিসি বলতে ইনভেস্টমেন্ট থাকতে হবে।”
সোহেল রানা আরও বলেন, “একজন বিনিয়োগকারীর যা টাকা আছে, দেখা যায় যেটা আইডিয়াল মানি পড়ে আছে ওইটা ইনভেস্টমেন্টে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে কারও যদি ১০০ টাকা আইডিয়াল মানি থাকে তার ৫০ টাকা ফান্ডামেন্টালে শেয়ারে ইনভেস্ট করবে। বাকি ২৫ টাকা সে হয়তোবা রানিং কোনো আইটেমের ওপর থাকতে পারে। আর বাকি ২৫ টাকা রিজার্ভে রাখবে। একজন বিনিয়োগকারী যে শেয়ার কিনছে সেটা যদি ডাউনটেনে চলে যায় তখন সে সেই রিজার্ভের টাকা আবার বাইব্যাক করবে। এভাবেই আসলে আমাদের বিনিয়োগে যাওয়া উচিত। তাহলে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন বলে আমি মনে করি। তবে ব্যাংক থেকে ধার করে, লোন নিয়ে ইনভেস্টমেন্টে যাওয়া ক্যাপিটাল মার্কেটের পলিসির সঙ্গে যায় না।”
তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন পর ফ্লোর প্রাইস তুলে নিয়ে সাময়িক মূল্য সংশোধনের পর শেয়ারবাজার কিছুটা গতি ফিরে পায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ায় প্রায় প্রতিদিন বাড়তে থাকে মূল্যসূচক। এতে ১১ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে উঠে আসে। কিন্তু চলমান ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে পড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক এখন ৫ হাজার ৯৬৮ পয়েন্টে নেমে গেছে। অর্থাৎ অব্যাহত দরপতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমছে ৪৭৯ পয়েন্ট। এছাড়াও অব্যাহত দরপতনের কারণে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এখন সেই বাজার মূলধন কমে ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকায় নেমে গেছে। অর্থাৎ বাজার মূলধন হারিয়েছে ৭৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমে গেছে।
জানা যায়, চলতি বছরের ১-১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১১ কার্যদিবসে ডিএসইতে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়। এর মধ্যে ১১ ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তার আগের কার্যদিবস ৮ ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয় এক হাজার ৮৫৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এখন সেই লেনদেন পাঁচশ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তার আগের কার্যদিবসে ১৯ মার্চ লেনদেন হয়েছিল ৪৬৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
শেয়ারবাজারে টানা দরপতন অব্যাহত থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। কেউ কেউ আবার শেয়ার বিক্রি করারও ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাদেরই একজন মো. ইকবাল হোসেন (ছদ্মনাম)।
২০১৭ সালে খুব শখ করে শেয়ারবাজারে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন ইকবাল হোসেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইয়ের কথামতো শেয়ারবাজারে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। তবে সেই বিনিয়োগ করা টাকা শুরুতে বৃদ্ধি পেলেও এখন প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগে নেমে এসেছে। ঘন ঘন শেয়ারবাজারের দরপতনের পাশাপাশি সূচক বাড়লে লেনদেন কমায় খুব একটা বেশি সুবিধা করতে পারছেন না তিনি। তাই শেয়ারবাজার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত তার।
সংবাদ প্রকাশের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মো. ইকবাল হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, “বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারের কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। এছাড়াও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সেটি বাস্তবায়নও দেখা যায়। ফলে শেয়ারবাজারের লেনদেন ইতিবাচক ধারায় ফিরতে থাকে। সেই সময় শেয়ারবাজারে ভালো ভালো আইপিও থাকায় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। তবে মাঝখানে শেয়ারবাজারের কিছু একটা কারণে আমাদের মতো বিনিয়োগকারীরা ধাক্কা খায়। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্রই শেয়ারবাজারের নামে নেতিবাচক গুজব ছড়াতে থাকে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ নিয়ে সবসময় নানা চিন্তা কাজ করছে।”
ইকবাল হোসেন আরও বলেন, “গত কয়েক বছরে যে সব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার বেশির ভাগই দুর্বলমানের কোম্পানি। আর এই দুর্বল কোম্পানির শেয়ার সেকেন্ডারি মার্কেটে এনে প্রথমে ম্যানুপুলেশন করে চড়া দাম হাঁকিয়ে বিনিয়োগকারীদের ঘচিয়ে দেওয়া হয় সুকৌশলে। এরপর বাজারে আসার দুই এক বছরের মধ্যে সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। আর আমাদের মতো বিনিয়োগকারীরা সেসব কোম্পানির শেয়ার কিনে সর্বসান্ত হন। এছাড়া আমাদের নীতি নির্ধারণী মহলও বিভিন্ন সময় বিনিয়োগকারীদের নির্ভয়ে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। কিন্তু যখন বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়েন, তখন অভয় দেওয়ার জন্য পাশে আর কেউ থাকেন না।”
শুধু মো. ইকবাল হোসেন একাই নন। তার মতো অনেকেই শেয়ারবাজারের দরপতনে হতাশা আর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। শেয়ারবাজারে কখনো সূচক বাড়ে লেনদেন কমে, কখনো বা আবার সূচক লেনদেন দুটোরই দরপতন দেখা যায়। দরপতন আর সূচক বৃদ্ধি-কমার এই ঘোড়প্যাচে পড়ে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারালেও শেয়ারবাজার নিয়ে ইতিবাচক কাজ করার কথা সংশ্লিষ্টদের মুখে শুধুই মধুরবাণী হিসেবে রূপ নিয়েছে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) ও ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার ধারণসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) এর এক তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরের ব্যবধানে দেশের শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৮ বা ৩৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
সিডিবিএল এর তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ৮ মার্চ শেয়ারবাজারে নারীদের বিও হিসাব ছিল ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯০টি। যা ৬ মার্চ দিন শেষে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৮২টিতে। তিন বছরের ব্যবধানে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৮টি বা ৩৭ দশমিক ১৭ শতাংশ নারী বিও হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের আগে শেয়ারবাজারে বিও হিসাবের বড় একটি অংশই ব্যবহার হতো শুধু আইপিও আবেদনের জন্য। আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বাজারে ৫০ হাজার টাকার ন্যূনতম বিনিয়োগের নতুন শর্ত দেওয়ার পর বিও অ্যাকাউন্ট আরও কমে। নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে যাওয়ার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ।
শেয়ারবাজারের এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা যখন ইতিবাচক আশা থেকে অনেকটাই দূরে যাওয়ার পথে সেখানে বুধবার (২০ মার্চ) পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সঙ্গে এক বৈঠকে ইতিবাচক আশার বাণী শুনিয়েছেন বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।
বৈঠকে ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, “পুঁজিবাজারের কল্যাণে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানসহ সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে বিএসইসি। দেশের পুঁজিবাজারে আরও গতিশীলতা আনতে বাজারে নতুন ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তকরণে জোর দিচ্ছে বিএসইসি। ইতোমধ্যে বিএসইসি বাজারে লিস্টেড প্রোডাক্ট বাড়ানোসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।“
শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, “পুঁজিবাজারের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো হ্রাস করতে কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধিসহ সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করবে।”