বাংলাদেশের যে উৎপাদন শক্তি তাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় চীনের ব্লকে যোগ দেওয়া ঠিক হবে না। এর কারণ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য নেই।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘কনভারসেশন উইথ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ’ শীর্ষক এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন।
এসব প্রেক্ষাপট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলসহ সামষ্টিক অর্থনীতির আরও বিভিন্ন খাত নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা চীন ও ভারতের ওপর। আবার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা। ফলে বাংলাদেশকে সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে হবে। কোনো জোটে যাওয়ার সুযোগ নেই। চীন, ভারতের সঙ্গে আমদানির জন্য সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আবার রপ্তানির জন্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সেখানেও রাজনীতি রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি মানবাধিকার ইস্যুতে জিএসপি প্লাস সুবিধা না দেয়, সেটা আমাদের জন্য ভালো হবে না।”
গত মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায়, চীনের নেতৃত্বে গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য জোট- রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসেপ)- এ যোগ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। আরসেপ জোটের দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যে বিদ্যমান শুল্কগুলো কমাতে ১০ থেকে ২৫ বছর সময় নিয়েছে। এই ব্লকে যোগ দিলে জোটের প্রতিটি দেশের সঙ্গে শুল্ক কমানোর জন্য পৃথক পৃথক আলোচনা করতে হবে বাংলাদেশকে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করবে। ফলে তার পরে বিশ্ববাণিজ্যে অনেক সুবিধা থাকবে না। কিন্তু উত্তরণের বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।”
তিনি বলেন, “কানাডা বাংলাদেশকে সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু, শুধু কানাডা সুবিধা দিলে হবে না। `ভিয়েতনাম ২৫ থেকে ৩০টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা কি ? বাংলাদেশ সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (সাফটা)-তে আছে। কিন্তু, সাফটা কাজ করেনি।”
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে ১৩০টি স্বল্পোন্নত দেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়েছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “বাংলাদেশও এরমধ্যে ছিল। কিন্তু শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ইস্যুতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে এই সুবিধা থেকে বের করে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই সুবিধা তৈরি পোশাকের জন্য দরকার না হলেও হস্তশিল্প, রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য দরকার।”
তিনি বলেন, “বাণিজ্য চুক্তিগুলো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই এ বিষয়ে জাতীয় নীতি থাকা প্রয়োজন।”
ব্রিকস প্রসঙ্গে বলেন, “এটি নতুন ভূরাজনৈতিক জোট। কিন্তু এই জোট খুব সফল হবে বলে মনে হয না । কারণ ব্রাজিল, ভারতের মত দেশ চীনের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে না।”
মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলছে– তারও নিজেদের স্বার্থেই তা বলছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ এসব নিয়ে কাজ করা দেশগুলো তাদের নাগরিকদের কাছে দেখাতে চায় যে তারা কিছু করছে। এরকম নতুন সমীকরণে ব্রিকস কতটা কার্যকর হবে তা দেখার বিষয়।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রেসটিজিয়াস প্রকল্পের চেয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের স্বস্তির জন্য কাজ করা জরুরি। যাতে এই শ্রেণির জনগণের জীবনমান বজায় থাকে। পাশাপাশি যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানব সম্পদ উন্নয়নেও জোর দিতে হবে। মানব সম্পদের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামোগুলো কঙ্কাল হয়ে থাকবে। কারণ অবকাঠামোর রক্ত, মাংস হচ্ছে উন্নত মানব সম্পদ। অন্যদিকে মানব সম্পদের উন্নয়ন না হলে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের ফাঁদে আটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
২০৪১ সালের পরিকল্পনা নিয়ে একটি কমিটিতে তিনি ছিলেন, একথা উল্লেখ করে বলেন, “সেখানে পরিকল্পনা কমিশন অনেক তথ্য দিয়েছে উন্নত দেশ হতে কি কি করতে হবে। উড়াল সড়কের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তবে এগুলোর খরচ অনেক। ঋণ নিয়ে করতে হয়। এর ব্যবস্থাপনায় অনেক ব্যয় ও দক্ষতাও দরকার। কিন্তু যেগুলো বিনা খরচে করা যায়, সেগুলো করবো না কেন? বিশেষ করে পরিবহনের শৃংখলা, নদী দখল বন্ধ। নিম্ন মানের অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধ করা এবং অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া।”
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেন, এই সড়কের দুই পাশে ব্যাপক বসতি ও বাজার রয়েছে।