বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট। এর ওপর রয়েছে বকেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ। এসব কারণে আমদানি কমে গেছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে উৎপাদনে। উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ না বাড়ায় সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে ভাটা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশের ফ্যাক্টরি আউটপুট বা শিল্পোৎপাদনের প্রবৃদ্ধি যেখানে ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেখানে চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে। যা বিগত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এর আগের দুই অর্থবছরে শিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতার এই হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে তীব্র পতন দেখা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ আমদানি ব্যয় সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সামগ্রিকভাবে আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
আবার গত অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে যেখানে ৫ হাজার ৮২৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৯২১ কোটি ৭ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে ২৯৬ দশমিক ৬২ কোটি ডলারের শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি হয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩৪৫ দশমিক ৫৭ কোটি ডলার মূল্যের মধ্যবর্তী পণ্য।
মূলত, গত অর্থবছরের চেয়ে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এসব পণ্য শিল্পের ফিনিশড প্রডাক্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে অন্যান্য মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ২০ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ৭১ দশমিক ৫ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৯২ দশমিক ৭০ কোটি ডলার। একইভাবে, তেলবীজ ১০ দশমিক ১ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্য ৭ দশমিক ২ শতাংশ, সার ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ, প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং লোহা, ইস্পাত ও বেস ধাতুর আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
শুধু তাই নয়, গত ৯ মাসে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১ হাজার ২১৭ কোটি ২২ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি কমেছে। আগের অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ খাতে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
আমদানিকারকরা বলছেন, “ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ আমদানিকারকের ঋণের সীমা বাড়াচ্ছে না। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো সীমিত যে ডলার পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আগের সমান পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।”
চলতি অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটল মেশিনারি), কাঁচামাল এবং শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্পোৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ওপর।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় কনজ্যুমারস গুডস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেছেন, “ডলার সংকট, ডলারের উচ্চমূল্য ও কিছু পণ্য অবৈধভাবে বাজারে আসার কারণে বড় বড় আমদানিকারকরা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমদানি কমে যাওয়ার পরও রিজার্ভ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর একমাত্র সমাধান হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো। আর সেজন্য বাড়াতে হবে রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বাজেট সহায়তা। এর জন্য ডলার-টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল হওয়া জরুরি।”