বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। যাতে পরিবেশ বিপর্যয়ে দেখা দিচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা, অস্বাভাবিক বর্ষণ, ভয়ঙ্কর বন্যা। প্রাকৃতিক এসব ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। সেজন্য সবার আগে দরকার জীবাশ্মা ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
বিশ্বের বহু দেশ বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। পিছিয়ে নেই ভারতবর্ষের দেশগুলো। এর মধ্যে বায়োগ্যাস উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে ভারত। দেশটিতে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণে বিকল্প উৎসের দিকে হাত বাড়াচ্ছে তারা। এর মধ্যে উপকরণের সহজলভ্যতা আর প্লান্ট স্থাপনে সীমিত বিনিয়োগের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম খাত হিসেবে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভারতে ৪৩ লাখের বেশি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এশিয়ার সবচেয়ে বড় কমপ্রেসড বায়োগ্যাস (সিবিজি) প্ল্যান্ট গড়ে উঠেছে উত্তর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লেহরাগাগায়। যা চালু করা হয়েছে ২০২২ সালের শেষের দিকে। এটি প্রতিদিন ৩০০ টন ধানের খড় থেকে ৩৩ টন বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে সক্ষম।
সরকারি হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বলছে, ভারতের গরুগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন মিলিয়ন টন গোবর আসে। সরকার চায় এসব গোবর ও অন্যান্য কৃষি বর্জ্য মিথেন তৈরিতে ব্যবহার হোক। তবে বর্তমানে ভারতে মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হয়ে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার বায়োগ্যাস শিল্পকে উৎসাহিত করতে আগামী ২০২৫ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহকারীদের এক শতাংশ বায়োমিথেনের সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস মিশানোর নির্দেশ দিয়েছে। যা ২০২৮ সালের মধ্যে বেড়ে হবে ৫ শতাংশ।
বায়োগ্যাস শিল্প মূলত, ভারতের গ্যাস আমদানি কমানোর পাশাপাশি বায়ুদূষণ কমাতেও সহায়ক হবে। তাছাড়া বায়োরিয়্যাক্টরের কাজ শেষ হওয়ার পর অবশিষ্ট উপাদানটি সার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় বড় বড় বায়োরিয়্যাক্টর তৈরি করা হচ্ছে।
বায়োগ্যাসে বাংলাদেশ
অনেকটা ভারতের মতোই উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম খাত হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে বায়োগ্যাসের। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়াও জনসম্পৃক্ততার অভাবে বায়োগ্যাস শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। ঠিক একইভাবে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ঝিমিয়ে পড়েছে।
দেশে বায়োগ্যাস উৎপাদনের ইতিহাস বহু পুরোনো। প্রথম বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে পরের ৫ দশকের বেশি সময় ধরে সহজধারার এই প্রযুক্তি সারা দেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি।
নেপালের মতো ছোট একটা দেশে যেখানে দুই লাখের মতো বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট রয়েছে সেখানে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সংখ্যা মাত্র এক লাখের মতো।
অথচ গবেষকরা বলছেন, উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে দেশে ৪০ লাখের বেশি বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট স্থাপনের সুযোগ আছে। স্রেডার হিসাবে দেশে বায়োগ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনার মাত্র আড়াই শতাংশ কাজে লাগানো হচ্ছে।
স্রেডার তথ্য অনুযায়ী, বায়োগ্যাস বা বায়োমাস থেকে বর্তমানে সারা দেশে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে এই খাত থেকে ৩১ দশমিক শূন্য ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সে লক্ষ্য অর্জন করা হয়নি।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ৯৫ হাজার গবাদিপশুর খামার ও ৯০ হাজার হাঁস-মুরগির খামারের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধিত খামারের বাইরেও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অনেক খামার। এসব খামার থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যা বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদনে কাজে লাগানো যেতে পারে।