বিশ্বে পোশাক রপ্তানির দিক থেকে চীনের পরেই বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান বাংলাদেশের। সেই ১৯৭৮ সালে দেশে প্রথম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। গত সাড়ে চার দশকে দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন তৈরি পোশাক খাত। মোট জিডিপির ১০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। গেল বছরে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
সূত্রমতে, পোশাক রপ্তানিতে চীন ছাড়া বিশ্বের আর সব দেশই রয়েছে বাংলাদেশের নিচের তালিকায়। প্রতিবেশী ভারতও পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সব সময় পশ্চিমা বাজার দখলের প্রতিযোগিতা করে আসছে। অতীতে বহুবার পোশাক খাতের অস্থিরতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে ভারত। তবে এবার সবচেয়ে বেশি সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশে পোশাক খাতের শ্রমিকদের অসন্তোষ থেকে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’।
ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল জুলাই-আগস্টে কোটা ও সরকার পতনের আন্দোলনের জেরে থমকে যায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের চাকা। সরকার পতনের পর সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও অস্থিরতা থামেনি পোশাক খাতে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বন্ধ রয়েছে অনেক কারখানা। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। এতে কমেছে উৎপাদন।
দেশে চলমান এই শ্রমিক অসন্তোষে চরম বিপাকে দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। চলমান অস্থিরতায় একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছেন শিল্পমালিকরা। তবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও এই অস্থিরতার সুযোগে বিদেশি অর্ডার লুফে নিচ্ছেন ভারতের পোশাক শিল্পমালিকরা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক খাতের চলমান অস্থিরতায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে অন্তত ১০-২০ শতাংশ। আর সেই সুযোগ লুফে নিতে মরিয়া প্রতিযোগী দেশগুলো। যার মধ্যে অন্যতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তুলা উৎপাদনকারী দেশ। এসব তুলা তারা বাংলাদেশে রপ্তানি করে। তবে ভারতে অনেক তুলা উৎপন্ন হলেও, তৈরি পোশাক খাতের দিক দিয়ে দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতার কারণে তারা নতুন করে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছে। গত আগস্টে স্প্যানিশ ফ্যাশন ফার্ম জারার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি অর্ডার পেয়েছে বলে জানিয়েছে আরেকটি গ্রুপ।
তবে শিল্প বিশ্লেষক মেহেদি মাহবুব দ্য ইকোনোমিস্টকে বলেন, “বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে এখনই টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা ভারতের নেই। বাংলাদেশের বর্তমানে পরিস্থিতি শিগগিরই কেটে যাবে। এরই মধ্যে শ্রমিকরা কারখানায় ফিরেছেন, উৎপাদনও বাড়ছে। এ ছাড়া পোশাক খাতে যেসব প্রতিযোগী আছে, তাদের চেয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন দিকে থেকে এগিয়ে আছে।”
মেহেদি মাহবুব আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘সতর্কমূলক আশাবাদী’ অবস্থানে আছে। এমনকি বাংলাদেশের পোশাককেই ইউরোপের বাজারগুলো প্রাধান্য দিয়ে থাকে।”
পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট আরেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে পোশাক শিল্পে পাল্লা দেওয়ার সক্ষমতা এই মুহূর্তে ভারতের নেই। ভারতে ইলেকট্রনিকের মতো মূলধননির্ভর খাতের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পোশাক শিল্পের মতো শ্রমিক নির্ভর খাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতের পোশাক রপ্তানির মূল্য কমেছে ১৫ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।”
এদিকে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে গত ১১ সেপ্টেম্বর তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি) এবং নন-আরএমজি খাতের শ্রম অসন্তোষ পর্যালোচনায় শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, “আপাতত শ্রমিকরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তাদের দাবিগুলো যাতে নিদিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে পারেন; সে লক্ষ্যে কমিটি করা হয়েছে।”