পানি পানি পানি। এই পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ। শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার, তখন মেলে না পানি। আর বর্ষায় যখন চারদিক পানিতে টইটম্বুর, তখন ছেড়ে দেওয়া হয় বাঁধ।
প্রতিবেশী ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দেশের ৫৩টি নদ-নদীতে বিরূপ প্রভাব চলেছে। পানিশূন্যতার ফলে মানুষের আয়ের উৎস, জীববৈচিত্র্যে, আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এর কারণে দেশ বর্তমানে কার্যত তিন ঋতুর দেশে পরিণত হয়েছে।
আর বাংলাদেশে যখন টানা বৃষ্টি আর চারদিকে ঢলের পানি তখন অসময়ে ডম্বুর বাঁধ খুলে দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি তারা গজলডোবা বাঁধও খুলে দিয়েছে। ফলে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ বিস্তৃত এলাকায় দেখা দিয়েছে প্রবল বন্যা।
ফারাক্কা ও তিস্তার গজলডোবা ব্যারেজের কারণে দেশের নদ-নদী শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই পানিশূন্য পড়ছে। এই পানিশূন্যতা এক দিনে হঠাৎ করে হয়নি। ফারাক্কা কারণে ৪৪ বছরের ধরে ধীরে ধীরে নদ-নদীর পানি শুকিয়ে গেছে শুষ্ক মৌসুমে। ফারাক্কার কারণে গঙ্গার স্রোতোধারার পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, বড়াল, চিকনাই, হুরাসগরসহ এর শাখা ও প্রশাখা নদ-নদী শুকিয়ে যায়। তিস্তা ব্যারাজের কারণে শুকিয়ে গেছে তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র যমুনা, করতোয়া, ফুলঝোরসহ এর শাখা-প্রশাখা নদী। একটি নদী অনেক শাখা নদী রয়েছে। মূল নদ-নদীর পানি প্রবাহ না থাকায় শাখা নদীতেও পানির টান পড়ে। উপনদীতে ধাক্কা লাগে। উপনদী মূল এবং শাখা নদী থেকে পানি নিয়ে অপর নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে না। পানিশূন্যতার ফলে দেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এই মরুকরণ এখন স্থায়ীরূপ নেওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এক সূত্রে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশকে জানায় যে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষা করা তাদের প্রয়োজন। সে সময় ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ১০ দিন ফারাক্কা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড গঙ্গার প্রবাহ প্রত্যাহার করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুমতি প্রার্থনা করে। বাংলাদেশ এতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। ভারত বাঁধ চালু করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের পরও একতরফাভাবে গঙ্গার গতি পরিবর্তন করতে থাকে যা ১৯৭৬ সালের পুরা শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা উন্নয়নে পলি ধুয়ে নিতে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদী থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভাগিরথী-হুগলী নদীতে ১১৩০ কিউবিক মিটারের বেশি পানি পৌঁছে দেওয়া।
গঙ্গা ও তিস্তার পানি অপসারণের কারণে শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার প্রারম্ভেই বাংলাদেশের উত্তর- দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে মাশুল দিতে হচ্ছে কৃষি, মৎস্য, বনজ, পানি সব ক্ষেত্রে। জীববৈচিত্র্যে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। আর বর্ষায় বাঁধ খুলে দেওয়ারও মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।