বর্ষপরিক্রমায় ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে শেষ হতে চলেছে আরেকটি বছর। ২০২২ সালে সারা দেশে ঘটে যায় আলোচিত ঘটনা-দুর্ঘটনা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৫১ জন। কক্সবাজারের চকরিয়ায় ছয় ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। আলোচনায় আসে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে বুয়েট শিক্ষার্থী ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এক আওয়ামী লীগ নেতার লাশ উদ্ধারের ঘটনা। এদিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও বদরুন্নেসা কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হন।
সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড
সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত ৪ জুন রাত সাড়ে নয়টার দিকে অগ্নিকাণ্ড থেকে বিস্ফোরণ হয়। অগ্নিকাণ্ডে ৫১ জন মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন দুই শতাধিক। ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় ডিপো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
চকরিয়ায় ৬ ভাই নিহত
চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট এলাকায় প্রয়াত বাবার শ্রাদ্ধ উপলক্ষে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে পাঁচটায় নয় ভাই-বোন শ্মশানে পূজা দিতে যান। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিকআপের ভ্যানের ধাক্কায় পাঁচ ভাই নিহত হন। পরে আহত আরেক ভাই রক্তিম শীল ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
এ ঘটনায় নিহতদের ভাই সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তভার প্রথমে হাইওয়ে পুলিশকে দেওয়া হলেও পরে পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজারের পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী বলেন, পিকআপের মালিক মাহামুদুল করিম অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন একজন চালকের হাতে গাড়িটি চালানোর জন্য তুলে দিয়েছেন, যা সড়ক পরিবহন আইনে অপরাধ। তাছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও তিনি (মাহামুদুল) আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। এ কারণে মাহামুদলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় মো. তারেক পিকআপভ্যানে চালকের পাশে বসা ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যেতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ কারণে তাকেও আসামি করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, চালক সাহিদুল ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে বুঝে গাড়িটি পেছনের দিকে চালিয়েছেন। ঠান্ডা মাথায় তিনি চালিয়েছেন। তার উচিত ছিল প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কিংবা পুলিশকে খবর দেওয়া। কিন্তু তা না করে আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়েছেন। তাই তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সুশীল বলেন, “আমি প্রথম থেকেই বলছি এটি দুর্ঘটনা নয়, এটি হত্যাকাণ্ড। দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলে আমরা সন্তুষ্ট হব।”
নিহত ৬ জনের মা মৃণালিনী বালা বলেন, “আমার ছেলেদের হত্যার সর্বোচ্চ বিচার চাই। হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে চাই।”
আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও শিক্ষার্থী প্রীতি হত্যা
রাজধানীর শাহজাহানপুরে গত মার্চ ২৫ অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও বদরুন্নেসা কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। নিহত শিক্ষার্থীর নাম সামিয়া আফরান প্রীতি (২২)। তিনি ঘটনার সময় রিকশায় তার বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন।
ওইদিন রাত ১০টার দিকে জাহিদ মতিঝিলের এজিবি কলোনি থেকে গাড়িতে করে শাহজাহানপুরে তার বাসায় ফিরছিলেন। আমতলা এলাকায় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে যানজটে আটকে থাকার সময় হেলমেট ও মাস্ক পরা একজন গাড়িতে তাকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়।
প্রীতির সঙ্গে থাকা বান্ধবী সুমাইয়া বলেন, “উত্তর শাহজাহানপুর থেকে তারা রিকশায় খিলগাঁও তিলপাপাড়া যাচ্ছিলেন। কে গুলি করেছে আমি জানি না।”
চাঞ্চল্য ছিল ফারদিন-বিপ্লবের মরদেহ উদ্ধার নিয়ে
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে শিক্ষার্থী ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এক আওয়ামী লীগ নেতার লাশ উদ্ধারের ঘটনা আলোচনায় আসে দেশজুড়ে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কৃষি উপ-কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুরন্ত বিপ্লব হত্যার ধরন ছিল প্রায় একই।
তাদের মধ্যে ফারদিনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এবং দুরন্ত বিপ্লবের মরদেহ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের দুজনকেই মাথায় ও বুকে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। হত্যার পর দুজনকেই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
জানা যায়, ১২ নভেম্বর বিকেলে বুড়িগঙ্গা নদীর পানগাঁও এলাকা থেকে দুরন্ত বিপ্লবের মরদেহ উদ্ধার করে পাগলা নৌ-পুলিশ। পরে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
১৩ নভেম্বর মৃতের বোন স্বাশতী বিপ্লব পুলিশের কাছে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। দুরন্ত বিপ্লব মোহাম্মদপুর এলাকার মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে। তিনি কেরানীগঞ্জ এলাকায় একটি কৃষি খামারের মালিক ছিলেন।
এর আগে রাজধানীর ডেমরা থেকে নিখোঁজের তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরে পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের সিম দিয়ে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের মরদেহ শনাক্ত হয়।
এর আগে গত ৫ নভেম্বর পরিবারের পক্ষ থেকে রামপুরা থানায় নিখোঁজের একটি জিডি করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শেখ ফরহাদ জানান, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নিখোঁজের দুইদিন পর উদ্ধার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তার মাথার বিভিন্ন অংশে ও বুকের ভেতরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এটি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছি এটা হত্যাকাণ্ড।
তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা থেকে উদ্ধার বিপ্লবের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। নিহতের মাথায় অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বুকেও রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। এটিকে প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, দুজনের মৃত্যুর কারণ মনে করা হচ্ছে হত্যা এবং ধরন একই। একইভাবে দুজনকে আঘাতে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
কিন্ত পরে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং অর্থাভাবের মত নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফারদিন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।
পুলিশের এমন বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে ফের আলোচনা শুরু হয়।