দেশে ডলার সংকট চলছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। এক সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও, ডলারের কারণে তা নেমে ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। টাকার ব্যাপক দরপতনের পর এখন ডলার ১১০-১২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। কার্ব মার্কেট থেকে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকরা।
ডলারের সংকটে দেশে আমদানি খাত অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই অবস্থার মধ্যেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। বাজেটে ঘিরে আমদানিকারকরা ডলার সংকটের সমাধান আশা করছেন।
তারা বলছেন, ডলারের দর বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন ও আমদানি খরচ বেড়েছে। যাতে পরিচালন ব্যয় বেড়ে গিয়ে বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কমতে শুরু করেছে চাহিদা।
আবার বেশি দামে ডলার কিনে এলসি খোলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুণতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। অনেক কারখানা আবার কর্মী ছাঁটাই করে ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকছে।
জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হুসাইন বলেন, “টাকার মান পড়ে যাওয়ায় আগের মতো একই পরিমাণের পণ্য আনতে ব্যয় বেড়েছে অনেক। ফলে উদ্যোক্তাদের অনেক চাপে পড়তে হয়েছে।”
আমীর আলী আশা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের প্রথম সারির ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, “এখন রড চলছে ৯২-৯৩ হাজার টাকা টন। যা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন ব্যয় বাড়ার কারণে আরও সমন্বয় করা হলে রডের দাম গিয়ে দাঁড়াবে এক লাখ টাকার ওপর। ভোক্তা কিন্তু এখন জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার বাইরে যাচ্ছে না।”
শাহরিয়ার জাহান রাহাত আরও বলেন, “শুধু ডলারের দর আর ব্যাংক সুদ যা বেড়েছে তাতেই আট হাজার টাকা উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। অথচ সেই সময়ের মধ্যে রডের দাম এক টাকাও বাড়ানো হয়নি। আসছে বাজেটে ডলার সংকট সমাধানে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ভারী শিল্প খাতের পরিস্থিতি বুঝে উপযুক্ত নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।”
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (সিমেন্ট, কয়লা ও এগ্রিগেটস) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, “ডলারের স্বাভাবিক জোগান না থাকায় অনেক কোম্পানি আমদানি নিয়মিত করতে পারছে না। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারায় বাজারে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামের কারণে সব পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। শুধু সিমেন্ট না, আমদানিনির্ভর সবকিছুর দামই বেড়েছে। প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকে পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় কার্ব মার্কেট ব্যবসায়ীদের প্রধান ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বিপত্তিও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের দর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সেই দামে কার্ব মার্কেটে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনে আমদানি চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন আমদানিকারকরা। হতাশ আর দুশ্চিন্তায় ভর করেই ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে তাদের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, এভিয়েশনসহ অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিটি খাতেই ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও বিদেশি কোম্পানির পাওনা পরিশোধ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম আমদানি, মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ আমদানির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ডলার-সংকট দূরীকরণের প্রধান হাতিয়ার তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। যেটা এখন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। যার খেসারত দিতে হয়েছে জনগণকে। তবে হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পণ্যের দামও বেড়ে গেছে।”