দিন দিন বাড়ছে বিকাশের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ব্যাপ্তি, ফলে ডিজিটাল আর্থিক সেবাগুলো হয়ে উঠছে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর্থিক লেনদেনে স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বেড়েছে সহজ, সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক সেবার মাধ্যমে। কিন্তু গ্রাহকদের অসাবধানতায় তারা অনেক সময় ঝুঁকির মুখে পড়েন। লেনদেন অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতারক চক্রও পরির্বতন করছে তাদের জালিয়াতি বা প্রতারণার ধরণ। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, বিশ্বাস, ভয়, লোভ ইত্যাদিকে পুঁজি করে এই অসাধু চক্রগুলো অভিনব সব জালিয়াতির ফাঁদে ফেলছে অনেক এমএফএস গ্রাহককে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত আর্থিক ক্ষতি এড়াতে গ্রাহকদের ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু সচেতনতা অবলম্বন করলে এমএফএস লেনদেন হতে পারে আরও নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং ঝুঁকিমুক্ত। আসুন জেনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু কৌশল।
পিন-ওটিপি নিয়ে সাবধানতা
এমএফএস অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (পিন) গোপন রাখা এবং কোনো অবস্থাতেই কারও সঙ্গে এটি শেয়ার না করা। বিকাশ অ্যাকাউন্টের পিন এবং বিভিন্ন লেনদেনের সময় পাওয়া ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) কখনো কাউকে জানানো যাবে না। এমনকি পিন-ওটিপি কোথাও লিখে রাখাও উচিত নয়। নিজের পিন নম্বর নিজেকেই মনে রাখতে হবে। এ ছাড়া এজেন্ট, মার্চেন্ট পয়েন্ট বা যেকোনো জনবহুল জায়গায় পিন টাইপ করার সময় আশপাশে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কেউ দেখতে না পায়। এ রকম কিছু সাবধানতা মেনে চললে এমএফএস অ্যাকাউন্ট থাকবে পুরোপুরি নিরাপদ।
পিন ভুলে গেলে করণীয়
পিন ভুলে গেলে বা কয়েকবার ভুল পিন দেওয়ার কারণে বিকাশ অ্যাকাউন্ট লক হয়ে গেলে গ্রাহকরা এত দিন ইউএসএসডি কোড *২৪৭# ডায়াল করে নিজেই নিজের অ্যাকাউন্টের পিন রিসেট করতে পারতেন। তবে কাজটি এখন বিকাশ অ্যাপ থেকেও করা যাচ্ছে। সম্প্রতি এই সেবাটি যুক্ত হয়েছে বিকাশ অ্যাপে। অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত বিরতিতে পিন রিসেট করাও সচেতনতার অংশ।
পিন রিসেট যেভাবে
বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করতে পিন নম্বর প্রয়োজন। বিকাশ গ্রাহক নিজের পিন নিজেই সেট করেন, ফলে পিন কেবল তিনিই জানেন এবং কারও পক্ষেই বিকাশ সিস্টেম থেকে ওই পিন জানার কোনো সুযোগ নেই। তাই পিন ভুলে গেলে ঘাবড়ে না গিয়ে অল্প কিছু তথ্য দিয়ে গ্রাহক অনায়াসেই সহজ কয়েকটি ধাপে পিন রিসেট করে নিতে পারেন।
পিন রিসেট করতে বিকাশ অ্যাপে প্রবেশ করে লগ ইন স্ক্রিন থেকে ‘রিসেট পিন’ অপশনে ট্যাপ করতে হবে। পরের ধাপে অনুমতি দিলে মোবাইলে আসা ৬ ডিজিটের অস্থায়ী পিন বা ওটিপি কোড স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাইপ হয়ে যাবে। এরপর ‘চেহারা স্ক্যান করুন’ অপশনে ট্যাপ করে নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করলে পরের ধাপে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হবে ও অস্থায়ী পিন পাওয়া যাবে। তা দেওয়ার পর শেষ ধাপে গ্রাহক নিজের পছন্দ অনুসারে এলোমেলো পাঁচ সংখ্যার নতুন পিন দিলেই সম্পন্ন হবে পিন রিসেট প্রক্রিয়া। এবার কাজ হলো নতুন পিনটি মনে রাখা এবং কারও সঙ্গে শেয়ার না করা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে অ্যাপ দিয়ে শুধু অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা বিকাশ পিন রিসেট করতে পারছেন। আইওএস ব্যবহারকারীরা পিন রিসেট করতে হবে আগের মতোই *২৪৭# ডায়াল করে। তবে শিগগিরই আইওএস ব্যবহারকারীরাও অ্যাপ থেকে পিন রিসেট করার সুবিধাটি পাবেন।
ইউএসএসডি ইন্টারফেস দিয়ে পিন রিসেট
ফোন থেকে *২৪৭# ডায়াল করে ‘রিসেট পিন’ অপশন সিলেক্ট করতে হবে। পরের ধাপে যে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে সেই নম্বরটি দিতে হবে। এরপর জন্ম সালের চারটি সংখ্যা দিতে হবে। তারপর গ্রাহককে বিগত ৯০ দিনের মধ্যে তার করা শেষ ১০টি লেনদেনের যেকোনো একটির তথ্য দিতে হবে। আর যদি শেষ ৯০ দিনের মধ্যে কোনো লেনদেন না করে থাকেন, তাহলে ‘নো ট্রানজেকশন’ অপশন নির্বাচন করবেন। গ্রাহকের দেওয়া সব তথ্য ঠিক থাকলে তিনি পাঁচ সংখ্যার অস্থায়ী পিন পেয়ে যাবেন। এরপর আবার *২৪৭# ডায়াল করে ‘মাই বিকাশ’ থেকে ‘চেঞ্জ পিন’ নির্বাচন করতে হবে। পরের ধাপে পুরোনো পিন চাইলে এসএমএস-এ আসা অস্থায়ী পিন নম্বরটি দিতে হবে। এরপর গ্রাহক নিজের পছন্দ অনুসারে পাঁচ সংখ্যার নতুন এলোমেলো পিন দিয়ে আর একবার রিএন্টার করে সফলভাবে পিন রিসেট করতে পারবেন।
ধাপে ধাপে কীভাবে পিন রিসেট করতে পারবেন তার বিস্তারিত https://www.bkash.com/help/reset-pin - এই লিংকে ক্লিক করে জেনে নিতে পারবেন গ্রাহক।
যে ধরনের কথা বলে জালিয়াতির চেষ্টা করে প্রতারকরা
অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে: আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে—বিভিন্ন সময় প্রতারক এমএফএস কর্মকর্তা সেজে এভাবে ভয় দেখিয়ে গ্রাহককে প্রতারণার জালে আটকান। এমন কোনো ফোন পেলে ঘাবড়ে না গিয়ে নিজে কাস্টমার কেয়ার সেবায় যোগাযোগ করুন।
নম্বরগুলো জানান: যখন কোনো গ্রাহক নতুন করে অ্যাপে লগইন করতে চান তখন বিকাশ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওটিপি বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড পাঠানো হয়। ওটিপি পাঠানোর পদ্ধতিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে প্রতারক আপনার আস্থা অর্জন করতে চান। ওটিপি কখনোই শেয়ার করবেন না। এমনকি বিভিন্ন সংখ্যার সঙ্গে যোগ-বিয়োগ করেও নম্বরগুলো জেনে নিতে চেষ্টা করে প্রতারক। কখনোই এই ফাঁদে পড়ে পিন বা ওটিপি শেয়ার করবেন না।
ভুল করে টাকা চলে গেছে: ভুল করে টাকা চলে গেছে, ফেরত দিন, এমন কথা বলেও আপনাকে প্রতারণায় ফেলতে পারে। কোনো টাকা ফেরত দেওয়ার আগে প্রথমেই নিজের ব্যালান্স যাচাই করুন।
খুব বিপদ: আপনার সন্তান/আত্মীয়/আপনজন বিপদে পড়েছে, টাকা পাঠান – ফোন করে বা সামাজিক মাধ্যমে মেসেজ দিয়েও প্রতারণার ফাঁদ পাতে জালিয়াত চক্র। যত বিপদের কথাই বলুক, টাকা পাঠানোর আগে নিজে ফোন করে তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কাস্টমার কেয়ারের মতো নম্বর: এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই ফোন করে গ্রাহকের কাছে পিন নম্বর বা ওটিপি জানতে চায় না। ওটিপি বলুক বা আইন্ডেটিফিকেশন নম্বর বলুক, কোনো নম্বর শেয়ার করা যাবে না। প্রযুক্তি অপব্যবহার করে কাস্টমার কেয়ারের মতো দেখতে প্রায় একই রকম নম্বর থেকে ফোন করে। যেমন: +০০০১৬২৪৭, যা দেখতে অনেকটা বিকাশের কাস্টমার কেয়ার নাম্বার ১৬২৪৭–এর মতো, ধরনের নম্বর থেকে কল করে প্রতারক ফোন দিয়ে বলে, আপনার মোবাইল অ্যাকাউন্টের তথ্য আপডেট করতে হবে না হলে বন্ধ হয়ে যাবে। এসব নম্বরের কল কেটে দিন।
লোভ দেখানো: চাকরি পেয়েছেন, লটারি জিতেছেন, টাকা দান করা হচ্ছে, অল্প বিনিয়োগে অধিক লাভ, প্রায় বিনা মূল্যে পাচ্ছেন দামি পণ্য এমন অসংখ্য প্রলোভনের ফাঁদ পাতে প্রতারকরা। তাই লোভে পড়ে প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে বিরত থাকুন।
দেশের অর্থনীতি অগ্রসরমান, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নত হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেম। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি লেনদেনের ক্যাশলেস বা লেস-ক্যাশ ব্যবস্থার দিকে। ডিজিটাল লেনদেন জনপ্রিয় হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে, যার প্রথম ধাপ হচ্ছে এমএফএস অ্যাকাউন্টের পিন এবং ওটিপি গোপন রাখা। এই একটি সচেতনতাই গ্রাহকের লেনদেনকে করবে সহজ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।