গত তিন দিনে কোটা আন্দোলনের অন্যতম ছয়জন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়ার পর তাদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ আটকে রেখেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবি। তাদের কাউকে নেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায়, কাউকে বাসার গেট ভেঙে তুলে আনা হয়েছিল ডিবি কার্যালয়ে।
আটকের পর ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নেওয়া হয়েছে পুলিশি হেফাজতে। প্রশ্ন হচ্ছে, কাউকে নিরাপত্তা হেফাজতে কতক্ষণ আটকে রাখা যায়?
আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেফাজতের নামে কাউকে নিয়ে যাওয়ারই কোনো আইন নেই। যদি সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার করতে হয় তাহলেও তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই।
সোমবার (২৯ জুলাই) বার্তা সংস্থা বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে পরিষ্কার করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে প্রডিউস করতে হবে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের আদালতে তোলা হয়নি।”
রোববার (২৮ জুলাই) নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওই সমন্বয়কদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে চাইলে তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
তবে, ডিবি অফিসে ওই সমন্বয়কদের খাইয়ে তাদের সঙ্গে কয়েকটি ছবি তুলে ও ভিডিও করে তা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।
এ নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। নিরাপত্তা হেফাজতে এর আগে এক বিএনপি নেতাকে খাইয়ে ছবি তুলেছিলেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
সোমবার আটক ওই সমন্বয়কদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে একটি রিট করা হয়। ওই রিটের শুনানিতে, গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে খাইয়ে সেই ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে মশকরা বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
পুলিশ হেফাজতে থাকা নিয়ে আইন কী বলছে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারকে গত শুক্রবার (২৬ জুলাই) বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ।
শনিবার (২৭ জুলাই) রাতে আটক করা হয় অন্যতম আরও দুইজন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে। রোববার (২৮ জুলাই) ভোরে আটক করা হয় আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে। মিরপুরের একটি বাসার গেইট ভেঙে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
গত শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত সবাই রয়েছে গোয়েন্দা হেফাজতে। তাদের আদালতে হাজির করা হয়নি বা কোনো মামলায় আটক বা গ্রেপ্তারও দেখানো হয়নি।
তাদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ পুলিশ হেফাজতে রেখেছে বলে দাবি করেছেন ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা হেফাজত বলতে আইনে কিছু নেই। হয় তাদের গ্রেপ্তার দেখাতে হবে, না হয় তাদের ছেড়ে দিতে হবে।
যদি নির্দিষ্ট মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজির করতে হবে আদালতে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৩৩ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “নিরাপত্তা হেফাজত একমাত্র আদালতের আদেশে হতে পারে। এখানে কোনো আদালতের আদেশ ছিল না।”
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “আটক বা গ্রেপ্তার করেন বা নিরাপত্তা হেফাজতে নেন আপনাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা আছে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ এর ২ ধারায় এটা বলা আছে। এভাবে আটকে রাখা সংবিধান লঙ্ঘন।”
আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “যদি সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার করতে হয় তাহলেও তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই। কাউকে নিরাপত্তার জন্য জেলে আটকে রাখার হাস্যকার যুক্তি ইতোপূর্বে কখনো শুনিনি।”