সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং শুরু করেছে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর। গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দেয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে সংগঠনটি। সম্প্রতি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেও দাবি তুলেছে।
হিযবুত তাহ্রীর দাবি করছে, ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংগঠনটির কর্মীরা মাঠে ছিল।
৫ আগস্টের পর সংসদ ভবনের সামনে প্রথম মিছিল করে নিজেদের প্রকাশ্য অস্তিত্ব জানান দেয় তারা। এরপর ঢাকায় অন্তত তিনটি বড় আকারের মিছিলও করেছে সংগঠনটি। এসব মিছিলে ঢাকার অনেক নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে।
২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হিযবুতকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। সেসময় তিনি বলেন, “হিযবুত তাহরীর জঙ্গি সংগঠন। সে ব্যাপারে আমাদের মামলা হয়েছে। আমাদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, চলবে। জঙ্গির ক্ষেত্রে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
আইজিপির কড়া বার্তার পাঁচ দিনের মাথায় নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির শীর্ষ একজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক বেশি ট্রমাটাইজড হয়ে ছিলেন। এজন্য প্রয়োজনীয় অভিযান বা আইনি তৎপরতা চালানো যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখন অ্যাকটিভ হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হিসেবে হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া শাখার প্রধান ইমতিয়াজ সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী হিযবুত তাহরীর এখনও নিষিদ্ধ সংগঠন। যদিও তারা নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রজ্ঞাপন বাতিলের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু যতদিন না পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়, ততদিন তাদের উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে ট্রিট করা হবে। এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মাসুদ করিম বলেন, “আমরা হিযবুত তাহরীর নিয়ে কাজ করছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর হিযবুতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ, খিলগাঁও এবং পল্লবী থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হিযবুতের মিডিয়া শাখার প্রধান ইমতিয়াজ সেলিম এজাহারভুক্ত আসামি। তাকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হিযবুতকে নতুন করে কারা সংগঠিত করছেন, তাদের বিষয়ে জানার চেষ্টা চলছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নিষিদ্ধ থাকার পরও হিযবুত তাহরীর তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। আগে তাদের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন কিশোর-তরুণদেরও মগজ ধোলাই করে নিজেদের দলে ভেড়ানোর কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ২০০০ সালে আত্মপ্রকাশ করে হিযবুত তাহরীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এই সংগঠনের নেতৃত্বে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধাবী শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে সদস্য সংগ্রহ করা হয়। সরাসরি কোনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়লেও হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা বাংলাদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৯টি দেশে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারও হিযবুত তাহরীরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়। যদিও এই সংগঠনের সরাসরি কোনও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার তথ্য নেই, তবে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তাদের ভাষায় ‘কুফরি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এছাড়া শুরু থেকেই সংগঠনটি দেশের সেনাবাহিনীকে ক্যু করার জন্য উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করে থাকে। হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মীদের টার্গেট সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসা।
যেভাবে মগজ ধোলাই করা হয় কিশোর-তরুণদের
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে দীর্ঘ দিন কাজ করে আসা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও হিযবুত যেহেতু আক্রমণাত্মক কোনও কর্মকাণ্ড করতো না, সেজন্য তাদের দিকে মনোযোগ কম ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা বেশি ব্যস্ত ছিল অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে। এই ফাঁকে গোপনে গোপনে সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে হিযবুত তাহরীর। তারা এখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও সদস্য বানাচ্ছে।
কিন্তু বর্তমানে তারা কথিত জিহাদের কথা বলছে। ঢাকার একাধিক মিছিলের ‘আপস না জিহাদ’ বলে স্লোগান দেয় এর নেতাকর্মীরা। এসব মিছিলে অংশ নেওয়া কয়েক হাজার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিশোর-তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলছেন, “শুরু থেকেই বিভিন্ন পাঠচক্রের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করতো হিযবুত তাহরীর। এখন তাদের কার্যক্রম অনলাইনেও চলছে। হিযবুতের সদস্যরা সবাই মেধাবী, উচ্চবিত্ত পরিবারের এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক। তাদের কথায় সহজেই মোটিভেট হচ্ছে কিশোর-তরুণরা।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “ধরেন, হিযবুতের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী, ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন, তিনি যদি কোনও কোচিং বা প্রাইভেট পড়ান, তো তার কথা তো স্বাভাবিকভাবেই কিশোর-তরুণরা শুনবে। প্রথমে ধর্মীয় বয়ান এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।”
কে এই ইমতিয়াজ সেলিম?
চট্টগ্রামের একটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করা ইমতিয়াজ সেলিম কাজ করতেন হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া বিভাগের প্রধান হিসেবে। ঢাকার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। ঢাকায় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হেড হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ইমতিয়াজকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তার কাছ থেকে হিযবুতের বর্তমান নেতৃত্বস্থানীয় সদস্যদের বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হবে।
কী বলছে সরকার
বিগত সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া বক্তব্য বিবৃতিতে হিযবুত তাহ্রীরকে একটি ‘নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংগঠনটির ব্যাপারে যে কঠোরতা ছিল সেটি বর্তমানে অনেকটাই শিথিল বলে অনেকে মনে করছেন।
অতীতে কখনোই হিযবুত তাহ্রীরকে এতটা সক্রিয় এবং তৎপর বাংলাদেশে দেখা যায়নি বলেও মত অনেকের। সরকার পতনের পর হিযবুত নেতাদের বেশ কয়েকজন জেল থেকে মুক্তিও পেয়েছেন। হিযবুত তাহ্রীরের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি এবং প্রকাশ্য তৎপরতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে দেখছে সেটি স্পষ্ট করছে না সরকার।
হিযবুত তাহ্রীর নিয়ে অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, হিযবুত তাহ্রীর একটি নিষিদ্ধ সংগঠন এবং সে অবস্থানেই আছে। সরকার এখন আইনশৃঙ্খলা পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কাজ করছে। পুলিশকে সক্রিয় করার জন্য সরকার কাজ করছে।
এ অবস্থায় এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।
“তবে হিযবুত তাহ্রীর বা যে কোনো সংগঠন যদি তাদের অবস্থান ব্যক্ত করতে চায় পরিস্কার করতে চায় সে সুযোগ আছে। তারা সরকারের সাথে কথা বলুক। আলোচনা করুক। আলোচনার মাধ্যমে সেটা একটা পর্যায়ে যাবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে সে অবস্থায় কিন্তু কোনোভাবেই তারা প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম করতে পারে না, এটি আইনবিরোধী হবে,” বলেন নাহিদ ইসলাম।
আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গীবাদ ইস্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা ছিল বলে মনে করেন অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন তাদের সরকারও সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কঠোর থাকবে।
“আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় জঙ্গীবাদকে ইস্যু করে আবার অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও শাস্তি দেয়া হয়েছে। গত রেজিম আসলে জঙ্গীবাদ ইস্যু করে একটা নিজেদের ক্ষমতা থাকার একটা ন্যায্যতা সবসময় রেখেছে,” বলেন নাহিদ ইসলাম।
“তারা (আওয়ামী লীগ) চলে গেলে এখানে জঙ্গীবাদ বেড়ে যাবে তো এই স্পর্ষকাতর বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। তবে আমরা অবশ্যই কোনো ধরনের জঙ্গী কার্যক্রম, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেবো না।”
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন