দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই টালমাটাল জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতি। দলের ভেতর বিদ্রোহ, অব্যাহতি ও বহিষ্কারে ফের মুখোমুখি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। সর্বশেষ রওশন এরশাদ জি এম কাদের ও মুজিবুর রহমান চুন্নুকে বহিষ্কার করে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে দলটির সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এ পরিস্থিতিতে দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।
জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক সমস্যার শুরু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে। চেয়ারম্যান জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা করেন। এ নিয়ে দলের রওশনপন্থীদের অসন্তোষ ছিল। তবে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন জেতে। অর্থাৎ সমঝোতার সবগুলো আসনও জিততে পারেনি দলটি।
এ নিয়ে রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় ঘেরাও করেন ও কাদের ও চুন্নুকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেন। এরপরই ১২ জানুয়ারি রওশন ঘনিষ্ঠ দুই নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ রায়কে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টির বিজ্ঞপ্তিতে তখন বলা হয়, “পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কাজী ফিরোজ রশীদকে কো-চেয়ারম্যান ও সুনীল শুভ রায়কে প্রেসিডিয়াম সদস্যপদসহ দলীয় সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন, যা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।”
এরপর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে দলটির ছয় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
সর্বশেষ রোববার (২৮ জানুয়ারি) গুলশানের নিজ বাসভবনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ও আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত, পার্টির বহিষ্কৃত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। সেই মতবিনিময় সভা থেকে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন তিনি। পরদিন সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের দায়িত্ব গ্রহণ এবং কমিটির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেন এ অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ।
তবে রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণার পর আবার জি এম কাদেরকে ফোন দিয়েছিলেন বলে দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রওশনপন্থি ওই নেতা বলেন, “আপার এগুলো করার ইচ্ছা ছিল না। তিনি সংবাদ সম্মেলনের পর কথা বলেছেন জি এম কাদেরের সঙ্গে। তিনি তাকে (জি এম কাদের) বলেছেন, এতগুলো নেতাকর্মী তাকে ঘিরে ধরেছে, তাদের আপাতত শান্ত করার জন্য তিনি এটা করেছেন। জি এম কাদেরকে তার মতো করে দল পরিচালনার কথা বলেছেন।”
এদিকে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারম্যান বা মহাসচিবসহ দলের কোনো নেতাকর্মীকেই প্রধান পৃষ্ঠপোষক দল থেকে বাদ দিতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা দলের একটা গঠনতন্ত্র আছে, নিয়ম আছে। আমাদের গঠনতন্ত্রে এমন কোনো ধারা নাই যাতে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদধারী দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিব বা অন্য কাউকে দল থেকে বাদ দিতে পারেন। এই ধরনের কোনো ক্ষমতা তার নাই। গঠনতন্ত্রের বাইরে মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো কথা বলতেই পারে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নাই।”
অন্যদিকে, জাতীয় পার্টি থেকে চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে গঠনতন্ত্রের ২০(১) ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন বলে জানান রওশন এরশাদ।
দলটির গঠনতন্ত্রের ২০(১) ধারাটিতে বলা আছে, প্রধান পৃষ্ঠপোষক পার্টির সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হবেন। পার্টির কোনো জনসভায় তিনি উপস্থিত থাকলে চেয়ারম্যানের উপরে তার স্থান হবে। জাতীয় ও দলীয় যে কোনো বিষয়ে প্রয়োজন মনে করলে চেয়ারম্যান তার পরামর্শ নেবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যারা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আছেন তারা যতক্ষণ সুবিধা পাবেন ততক্ষণ দলে থাকবেন। সুবিধা না পেলে দলে থাকবেন না, তখন আবার ভাঙবে। একটা সময় জাতীয় পার্টির অবস্থা মুসলিম লীগের মতো হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “জাতীয় পার্টির নেতারা যারা আছেন, তারা প্রচণ্ড সুবিধাবাদী। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তারা সব ধরনের সুবিধা নিতে চান। তাদের মধ্যে আদর্শবাদী কোনো জায়গা নেই। নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। তাদের দলে ভাঙন হবে, বিপর্যয় হবে-এটাই স্বাভাবিক।”