• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বৈদেশিক ঋণ, ডলারের চাপে রিজার্ভ


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৪, ০৯:৫৯ পিএম
বৈদেশিক ঋণ, ডলারের চাপে রিজার্ভ
ডলার। ফাইল ফটো

অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত আড়াই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি দায় মেটাতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম। যা ২০১৩ সালের পর এত নিচে নামেনি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক (গ্রস) হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মোতাবেক হিসাব করে সেই ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় ১৩ বিলিয়নের কাছাকাছি। সে সময় রিজার্ভ নিয়ে এতটা আলোচনা না হলেও বর্তমানে রিজার্ভের প্রবণতা কমা নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো পরিমাণ রিজার্ভ থাকা জরুরি। এখন রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ আছে। কেননা, এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের তিন মাসেরও আমদানি দায় মেটানো যাবে না।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের ১২-১৩ মাস ও ভিয়েতনামের ৭-৮ মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেও দ্রুত সম্প্রসারণশীল অর্থনীতি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তিন মাসের আমদানি চাহিদা মেটানোর রিজার্ভও নেই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা যে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছি, সেটার বেশি করে মূল্য পরিশোধ শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। এখন প্রতিমাসে এক বিলিয়ন ডলার কমে যাচ্ছে। যা আমরা ইনকাম করছি তার থেকে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর না বেড়ে কমছে। অন্যদিকে, আগে বৈদেশিক ঋণের সুদ আসলে এখনকার মতো ছিল না। বর্তমানে সেই ঋণের সুদ প্রায় তিনগুণ হয়ে গেছে। এটি বিপদের কারণ।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক (গ্রস) হিসাবে দেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২২ দশমিক ৩ বিলয়ন ডলার। এরপর থেকে রিজার্ভে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ২০১৫ সালে ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন, ২০১৬ সালে ৩২ দশমিক ১ বিলিয়ন এবং ২০১৭ সালে ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ কিছুটা কমে আবারও ৩২ বিলিয়ন ডলারে নামে। এরপর আবারও উর্ধ্বমুখী ছিল রিজার্ভ।

২০১৯ সালে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন। পরের বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে। এরপর ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় রিজার্ভ। তবে এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে থাকে।

২০২১ সালে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০২৩ সালে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছিল ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। সার্বিক হিসাবে চলতি বছরের ১৩ মে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

মূলত, গত দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংকট কাটছে না। ব্যাংকগুলোতেও পর্যাপ্ত ডলার মিলছে না। সময়মতো এলসি না খোলায় ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও বলেন, “আইএমএফ রিজার্ভের যে তথ্য দিচ্ছে, আমার দৃষ্টিতে এটা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বা রপ্তানি আয় বেশি বাড়লে রিজার্ভ বাড়তে পারতো। তবে সে সম্ভাবনা খুব কম। আসলে বৈদেশিক এত ঋণ নেওয়া আমাদের ঠিক হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকায় তৈরি হচ্ছে বড় বড় মেগা প্রকল্প। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি বৈদেশিক ঋণ আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “সময়মতো ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা ও পুরো রপ্তানি আয় দেশে না আসায় সংকট যাচ্ছে না। বাণিজ্যঘাটতি কাটছে না, আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি বাড়ছে। ফলে ডলার–সংকট না কাটায় রিজার্ভের পতন হচ্ছেই। তাছাড়া ডলারের দাম নির্ধারণে যে ধরনের নীতি নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটাই টেকসই হচ্ছে না। এখন নতুন পদ্ধতিও বাজারভিত্তিক না।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সাম্প্রতিক বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে যেসব পদক্ষেপ রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো দেশের রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের মধ্যে রাখতে হয়। তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে না। তবে সেটি যদি তিন মাসের নিচে চলে যায় তাহলে বাণিজ্যে প্রভাব পড়তে পারে। চলমান রিজার্ভের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে বৈদেশিক বাণিজ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবশ্য আগামী জুনে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হলে রিজার্ভ অনেকটা শক্তিশালী হবে।

মধুমতি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “কোনো দেশের রিজার্ভ যখন ভালো অবস্থানে থাকে বা ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন এলসি খুলতে গেলে কনফারমেশন চার্জ কম লাগে এবং কোনো কোনো সময় কনফারমেশন ছাড়াই এলসি খোলা যায়। কিন্তু রিজার্ভ যখন নিম্নমুখী থাকে, তখন কনফারমেশন চার্জ বাড়ে, আমদানি খরচও বাড়ে। এতে পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব তৈরি হয়। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ যে অবস্থানে রয়েছে সেটি খুব বেশি খারাপ না হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।”

Link copied!