জমি কেনাবেচা বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে না করা হলে বিপত্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মালিকানা-সংক্রান্ত জটিলতা যেমন একটি ইস্যু, আবার নানা ধরনের জালিয়াতির শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটে প্রায়ই।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, তাড়াহুড়ো না করে জমি কেনার আগে কিছু বিষয় যাচাই করে নিতে পারলে প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো, যেগুলো জমি কেনার আগেই লক্ষ রাখা জরুরি।
কাগজপত্রের কপি
জমি কেনার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মালিকানার প্রমাণসংক্রান্ত দলিল ও কাগজপত্র। যেসব কাগজপত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করতে হবে সেগুলো হচ্ছে হচ্ছে জমির দলিল, ওয়ারিশ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), সিএস/ এসএ/ আরএস/ মহানগর/ মিউটেশন পড়চা, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা ইত্যাদি।
বিশেষত দলিল, মিউটেশন বা নামজারির কাগজপত্র এবং খাজনা হালনাগাদের তথ্যের দিকে প্রাথমিকভাবে জোর দেন আইনজীবীরা।
জমিভেদে সিএস, আরএস বা অন্য কাগজেরও প্রয়োজন হতে পারে, তাই যত দূর সম্ভব সেগুলো জোগাড় করা প্রয়োজন, যাতে জমিসংক্রান্ত অতীত তথ্য, বর্তমান মালিকানা, পরিমাপ ইত্যাদির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই সম্ভব হয়।
যিনি জমি বিক্রি করছেন তিনি ক্রয়-সূত্রে নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হয়েছেন, এ বিষয়গুলোও পরিষ্কার হতে হয়। যদি উত্তরাধিকার-সূত্রে হয়, তাহলে অন্য উত্তরাধিকার আছে কি না, সেটি যাচাই করা জরুরি।
কাগজপত্র যাচাই
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই করতে তিনটি অফিসে যেতে হবে। তহশিল বা ভূমি অফিস, এসি (ল্যান্ড) বা সহকারী ভূমি অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রার অফিস।
তহশিল বা ইউনিয়ন ভূমি অফিস : জমির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পেতে তহশিল অফিস সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ।
খাজনার রসিদটি সঠিক কি-না, প্রস্তাবিত দাগ ও খতিয়ানের জমির প্রকৃত মালিক কে, জমিতে কোন সরকারি স্বার্থ জড়িত আছে কি না, সেটি দেখতে হবে। এখানে সরকারি স্বার্থ বলতে খাস জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ওয়াকফ এস্টেট এবং সরকারি অধিগ্রহণের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
এসি ল্যান্ড অফিস–মিউটেশন বা নামজারি সংক্রান্ত তথ্য বা দ্বন্দ্বের বিষয়ে নিশ্চিত হতে যেতে হবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে। বিক্রেতার নামজারির কাগজপত্র (মিউটেশন পড়চা, ডিসিআর) ঠিকঠাক না হলে জমি রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হবে না। তহশিল এবং এসি (ল্যান্ড), এই দুই অফিস থেকে তথ্য যাচাইয়ের দিকে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে।
সাব-রেজিস্ট্রার অফিস– তহশিল এবং এসি ল্যান্ড অফিস ছাড়াও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যেতে হবে।
কাগজপত্রের তথ্য পাওয়ার পর জমি কিনতে সরেজমিনে গিয়ে দেখতে হবে। এতে করে জমিটি কেমন, সেখানে কোনো ডোবা বা পুকুর আছে কি না, রাস্তার অবস্থান কী, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে। এ ছাড়া সেই জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে কি না, বা জায়গা যেমন কাগজে উল্লেখ রয়েছে তার থেকে কমবেশি আছে কি না, সেসব বিষয়ে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
এ ছাড়া এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ‘ভূমিদস্যু’রা সংশ্লিষ্ট জমির আশপাশে থাকতে পারে, যারা ‘সব ঠিক আছে’ এমন ধারণা দিতে পারে। জায়গাটি ‘একাধিকবার ভিজিট’ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি, কারণ তার মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতায় “দশজন মানুষ হলে একজন অন্তত থাকে যিনি গোপনে হলেও সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।”
এছাড়া সম্ভব হলে ভূমি অফিসের ম্যাপ সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী জমির উল্লেখিত দাগ মিলিয়ে নিতে পারলেও ভালো হয়।
পরামর্শ গ্রহণ
জমির কাগজপত্র ও সরেজমিন যাচাই - দুটো ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করা ব্যাপারে জোর দেন আইনজীবীরা।
জমিসংক্রান্ত ভালো জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
আরও কিছু সতর্কতা
এতো কিছু নিশ্চিত করে নেয়ার একটা বড় উদ্দেশ্য জমি নিষ্কটক নিশ্চিত করা। কারণ মামলা মোকদ্দমায় বা মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ পরবর্তীতে ক্রেতার জন্য বাড়তি ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে।
বড় জমি বা বেশি মূল্যবান সম্পত্তির ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দিতে হবে।
অনেক সময় পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মাধমে জমি কেনাবেচা হয়। সেক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সহায়তায় মূল মালিকের সঙ্গে অন্তত যোগাযোগ করে নেওয়া প্রয়োজন।
কারণ, এমন অনেক মামলা পরবর্তী সময়ে আসে যেখানে ভুয়া পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মধ্য দিয়ে জমি বিক্রি করা হয়।
যেকোনো অবস্থাতেই জমি কেনার ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে আলোচনা না করে সরাসরি মালিকের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এসব কিছু যাচাই করতে সময় লাগলেও কম দামে কিনতে তাড়াহুড়ো করতে গেলে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
কেনার সময় করণীয়
জমির সব কাগজত্রের বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকলে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে দলিল প্রস্তুত করতে হবে।
দলিল লেখার সময় অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়, তাই দলিল চূড়ান্ত করার আগে ড্রাফটে যা যা বলা হয়েছে সেসব তথ্য সঠিকভাবে এসেছে কি না, সেগুলো যাচাই করে নিতে হবে। পরপরই মিউটেশন বা নামজারির জন্য আবেদন করতে হবে। এখন নামজারির বিষয়টি অনলাইনে করে নেওয়া সম্ভব।
এর বাইরে “আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রসিদ নেওয়ার এবং সাক্ষী রাখার” এবং “যতটা সম্ভব চেক বা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাপয়সা লেনদেন” করতে হবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা