সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে চারপাশ। আমরাও বদলে নিচ্ছি নিজেকে। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়ার সময়সঙ্গী এখন প্রযুক্তি। তাই আধুনিক কম্পিউটার ও প্রযুক্তিবিদ্যায় নিজেদের উপযোগী করে নিচ্ছে পৃথিবীর তরুণ সমাজ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণেরাও নিজেদের গড়ে তুলছে প্রযুক্তি-সম্ভারে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হচ্ছেন তারা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে আগামী ১৫ বছরে তরুণদের জন্য অন্তত ৬০০ মিলিয়ন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে, যা নাকি আমরা কল্পনা করতেও পারছি না।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে ৫টি বিষয়ে বাংলাদেশের তরুণরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল লিটারেসি, ফ্রিল্যান্সিং, ভাষা শিক্ষা, উদ্যোক্তা হওয়া ও যোগাযোগে উন্নতি।
ডিজিটাল লিটারেসি
ডিজিটাল লিটারেসি হলো প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমকে বোঝা এবং সেগুলোকে ব্যবহার করে নিজেকে প্রস্তুত করা। জ্ঞান অর্জনের এ বিষয়টি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের প্রথম পছন্দ। তারা যেকোনো উপায়েই প্রযুক্তির ভাষা বুঝতে চান এবং কাজে লাগাতে চান। এসব অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে তরুণ সমাজ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছেন এবং উপার্জন করছেন।
এমন ডিজিটাল লিটারেসির জন্য অবশ্যই দরকার পড়ে কম্পিউটার পরিচালনার প্রাথমিক জ্ঞান। তবে তরুণদের এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিরা বলছেন, সবার জন্য ডিজিটাল সুবিধা সমান না থাকায় দক্ষতা অর্জনে অনেকেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
ব্র্যাকের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক তাসমিয়া রহমান বলেন, উপযুক্ত সুবিধা না থাকায় তরুণদের এক বিশাল অংশ ডিজিটাল লিটারেসি থেকে বঞ্চিত থাকছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা এই জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন না।
ফ্রিল্যান্সিং
ফ্রিল্যান্সিং হলো কোনো নির্দিষ্ট চাকরিতে না থেকে নিজের মতো করে উপার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। ফ্রিল্যান্সিংয়ের এই পদ্ধতি মূলত প্রথাগত চাকরির ধারণা ভেঙে দিয়েছে সমাজে। কারণ, এর জন্য কোনো অফিস লাগে না। সময়ও বেঁধে দেওয়া থাকে না। নিজের মতো করে যখন তখন বাসায় বসে কাজ করা যায়।
এই ধারণা আগে থেকে থাকলেও বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যম সারা বিশ্বে এর দ্বার খুলে দিয়েছে ব্যাপক হারে। ফলে ফ্রিল্যান্সিং হয়ে পড়েছে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর কাজ।
ধরুন আপনি সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামিং জানেন, গ্রাফিক ডিজাইন বা কোডিংয়ে দক্ষ হলে যেকোনো ওয়েবসাইটে ঢুকে কাজ খুঁজে নিতে পারবেন। কাজ অনুযায়ী আপনার উপার্জন হবে। এমন নানা রকমের প্রযুক্তিবিদ্যার কাজ আছে, যা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপার্জন করা যায়।
আমাদের দেশে এখন অনেক ফ্রিল্যান্সিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। যারা অনলাইন থেকে কাজ খুঁজে এনে তরুণদের সেসব কাজে যুক্ত করছে। এসব কাজে অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলে। এ জন্য এখন ফ্রিল্যান্সিংয়েই বেশি মনোযোগ তরুণদের।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাব্বির বলেন, “আমি তিন বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করছি এবং স্বাবলম্বী হয়েছি। এ জন্য কোনো চাকরির চেষ্টা করিনি।”
ভাষা শিক্ষা
বর্তমান সময়ের তরুণদের আরেকটি আগ্রহের নাম ভাষা শিক্ষা। বাড়তি অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষায় অনেক বেশি আগ্রহী এখনকার তরুণরা। বর্তমান সময়ে সব দেশেই অন্য ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখা আবশ্যকীয় বলা যায়। এ ছাড়া প্রযুক্তি যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করে দেওয়ায় বাড়তি দু-একটা ভাষা শিখে রাখা তরুণদের কাছে যেমন প্রয়োজনের, তেমনি শখেরও বটে। এ জন্য দেশের তরুণরা ইংরেজি শেখার পাশাপাশি অন্য ভাষাও শিখছেন। এই ভাষা দেশে-বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রাখে। কখনো বাড়তি যোগ্যতা, আবার কখনো দোভাষীর ভূমিকাও রাখা যায়।
উদ্যোক্তা
চাকরি না করে নিজের মতো স্বাধীনভাবে কিছু করা অনেক ভালো। তাই চাকরির বাইরে এখন অনেক তরুণই স্বল্প বিনিয়োগে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়েছেন। ক্ষুদ্র থেকে সাফল্যের গতি আবার নিয়ে যাচ্ছে অসাধারণ কিছুতে। আমাদের দেশে এমন উদাহরণ এখন হাজার হাজার।
উদ্যোক্তা হতে হলে নিখুঁতভাবে ব্যবসা পরিচালনের দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কীভাবে নতুন ব্যবসা শুরু করা যায়, ঝুঁকিগুলো কী কী, মার্কেটিং পলিসি নির্ধারণ, মুনাফা অর্জনসহ ব্যবসার যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এসব অভিজ্ঞতা নিতে হয় বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। অনলাইনে ইউটিউবসহ প্রযুক্তির নানা মাধ্যম থেকে এখনকার তরুণরা এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপর নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
রাজধানীর বাসাবো এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র সৈকত হোসেন মনে করেন, উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমেই লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তারপর লক্ষ্য বাস্তবায়নে কী কী করতে হবে, তার খুঁটিনাটি সবই আপাদমস্তক নিজেকে ধারণ করতে হবে। যাতে কোনোটিই বাদ না পড়ে। কারণ, একজন উদ্যোক্তার ব্যবসার সবকিছুই নির্ভর করে তার বিনিয়াগ, ব্যয় পরিচালন, আয় এবং ব্যবসার ক্ষেত্রের ওপর। এসব খুঁটিনাটি বিষয় সব সময় মাথায় রেখেই উদ্যোক্তাকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে, ব্যবসায় লোকসান গুনতে হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের সাফল্য থেকে ধীরে ধীরে একসময় বড় বিনিয়োগকারীতে পরিণত হবে। ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা একসময় বড় আর বিস্তর চিন্তার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করে এবং ব্যবসা পরিচালনে বিরাট সহায়ক হয়।
এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, এখন সামাজিক মাধ্যমসহ অনলাইনের নানা মাধ্যমে বিস্তর সাফল্যের গল্প পাওয়া যায়। অভিজ্ঞতা শেয়ার হয়। একে অপরকে সহযোগিতা করে। এভাবে দেশের আনাচে-কানাচে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে এবং তারা সাফল্য পাচ্ছে।
যোগাযোগ
বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জন্য যোগাযোগ এক অনন্য মাধ্যম। যোগাযোগ সহজ না হলে কোনো কিছুই সহজ নয়। তাই যোগাযোগের জন্য নিজেকে অবশ্যই সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
এর মধ্যে যোগাযোগের প্রথম মাধ্যমটা হচ্ছে আপনার কথা বলা কতটা সহজ আর সাবলীল। অনেকের যোগ্যতা বা সার্টিফিকেটের ঝুড়ি বিশাল হলেও যোগাযোগ সহজ না হওয়ার কারণে পিছিয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
বর্তমানে অনলাইনে অফলাইনে যোগাযোগে দক্ষতা বাড়াতে নানা রকমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। তরুণদের অনেকেই এই মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং বিভিন্ন কর্মস্থলে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে।
যোগাযোগ প্রশিক্ষক সাদমান রহমান বলেন, ধরুন আপনি গ্রাফিক ডিজাইনে ভালো অভিজ্ঞ, কিন্তু কাজটি কোথায় গিয়ে করতে পারবেন বা কাজে লাগাতে পারবেন, তা আপনি জানেন না। এ জন্য প্রয়োজন যোগাযোগ। এই যোগাযোগের জন্য আপনার বাচনভঙ্গিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। আপনার সহজ উপস্থাপনা কাজটিকে সহজ করে দেয়। এই কমিউনিকেশন প্রতিটি পেশার মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এক বিষয়।
যোগাযোগের জন্য ভাষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে চাকরি পেতে বা উপার্জন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে। এ কাজে পারদর্শী হলেই আপনি পছন্দের কাজটি খুঁজে নিয়ে চেষ্টা করতে পারবেন।
বর্তমানে আমাদের তরুণরা যোগাযোগে এগিয়ে যেতে নানা মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং নিজেদের কাজে লাগানোর চেষ্ঠা করছে। সাফল্যও পাচ্ছে দারুণভাবে।
প্রশিক্ষক সাদমান বলেন, তরুণদের এই নিরলস চেষ্টা আগামীর বাংলাদেশের জন্য উজ্জ্বল সময় বয়ে নিয়ে আসবে।