রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ড যেন থামছেই না। সম্প্রতি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুন যার প্রমাণ দিচ্ছে। তাছাড়া পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ড এখনো দাগ কেটে রয়েছে নগরবাসীর মনে। পাশাপাশি বঙ্গবাজার, নিউ মার্কেট অগ্নিকাণ্ডগুলো তো আছেই।
ভয়াবহ এসব আগুন ও মর্মান্তিক মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি বেশ ভাবিয়ে তুলছে নগরবাসীকে। তারা মনে করছেন, এই শহর আর বসবাসযোগ্য নয়। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তির দায়ভার নিয়েও প্রশ্ন করেছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বয় সেইসঙ্গে সুশানের অভাবে ঘটছে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আর দায়িত্বশীলদের ভাষ্য, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুতই বন্ধ হবে এসব সমস্যা এমন প্রত্যাশা তাদের।
ফায়ার সার্ভিসের ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল মিলিয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৯টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি।
দপ্তরটির তথ্য বলছে, ২০১৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৩৮১টি প্রতিষ্ঠানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে এবং এতে জরিমানা করা হয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ১০০ টাকা।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কেমন এবং তা না মানলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, “প্রথমে নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর নোটিশ না মানলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে বর্তমানে মামলা বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা করা হয়।”
বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের জানান, ইমারত বিধিমালা পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ও পূর্বের ঘটনার আলোকে জরুরি সাড়া প্রদানের জন্য নীতিমালা খসড়া প্রস্তুত করার কথা।
বেইলি রোডের ঘটনার বিষয়ে কথা হয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের সঙ্গে। তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন শুধু ট্রেড লাইসেন্সের হালনাগাদ দেখে। বেইলি রোডের ভবনটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্সগুলো হালনাগাদ করা ছিল। এটা বাণিজ্যিক ভবন, সুতরাং বাণিজ্যিক ভবন হিসাবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। চুরিহাট্টার ঘটনার পর থেকে কেমিকেল গোডাউনের ক্ষেত্রে কোনো ট্রেড লাইসেন্স দেয়নি সিটি করপোরেশন। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ পুরান ঢাকার কেমিকেল গোডাউনের তালিকা চেয়েছে তা দেওয়া হয়েছে।”
বেইলি রোডের ভবন পরিদর্শন শেষে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলামও বলেছিলেন ঝুঁকিপূর্ণের কথা। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে? এই বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ঢাকা শহরে এমন অনেক ভবন রয়েছে, যারা আবাসিক করেছিলেন, তারা পরে বাণিজ্যিক হয়েছেন। এর পরিমাণ প্রায় ৭৭ শতাংশ। এগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নিলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক থাকবে না। অনেকেই কর্মসংস্থান হারাবে।”
জনবল সংকটের কথা জানিয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, “এই শহরে এক তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজারের বেশি। তাছাড়া প্রতি বছর ২০ হাজারের মতো ভবন নির্মাণ হচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য নির্মাণকালীন সময় তদারকি করা। এই শহরের জনসংখ্যার অনুপাতে ইন্সপেক্টর থাকা দরকার ন্যূনতম ৫ হাজার। কিন্তু রয়েছে ১৪০ জন।”
সুশানের কথা জানিয়ে রাজউকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “সুশাসন সব জায়গার মধ্যে আনতে হবে। রাজউক যেমন তদারকি করবে, তেমনই যারা ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স দেবেন তাদেরও তদারকি করতে হবে। রাজউক তৃতীয় পক্ষ (কারিগরি দল) নিয়োগ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা তদারকি করবে। এই মুহূর্তে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে সাইনবোর্ড টাঙানোর জন্য বলা হয়েছে।”
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের আগে যেসব অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, “সিদ্দিক বাজার দুর্ঘটনার পর রাজউক অনুমোদনহীন এক হাজার ৮০০ ভবনকে নোটিশ দেওয়া হয় এবং সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়, রাজউকের সার্টিফিকেট ছাড়া তাদের যেন কোনো সুবিধা না দেওয়া হয়। তাছাড়া গত বছর এক হাজার ৮৯০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে আন্তঃসংস্থা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সতর্ক করার কার্যক্রম করছে। আমরা আশাবাদী আগামী ২ বছরের মধ্যে ঢাকা শহর দুর্যোগ সহোনীয় শহর হয়ে উঠবে।”
ঘটনা দায়ভার নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “একটি ভবনের দুর্ঘটনার সঙ্গে সকলের দায় রয়েছে। নকশা করা থেকে শুরু করে লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবার দায় সমান। দুর্ঘটনা ঘটার পর রেস্তোরাঁর মালিক বা সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করে নয়, যারা অনুমোদন দিয়েছে সংশ্লিষ্ট তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। অবৈধ উদ্দেশ্যে কেউ কেউ সুশাসনের আগ্রহী নন। সমন্বয় এবং সুশান প্রতিষ্ঠা হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।”