বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, “আমেরিকায় মেয়রেরা পুলিশ, পানি, যোগাযোগসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে এমন হয় না।
কাজের ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মেয়রদের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের থেকে কম। তাদের কোনো কিছু পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই।”
শনিবার (১৩ জানুয়ারি) রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) কর্তৃক আয়োজিত ‘স্থায়ীত্ব নগরায়ণ : সমস্যা ও সমাধান’—শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার সহসভাপতি নজরুল ইসলাম।
বাপার সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঞ্চালনায় রেহমান সোবহান বলেন, “নিউইয়র্ক শহরে মেয়র সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তিনি শহরের যানবাহন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আমেরিকাতে মেয়র তার শহরে পুলিশ থেকে শুরু করে পানি ও অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে এমন হয় না।”
অধ্যাপক রেহমান সোবহান জানান, ১৯৯১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের মেয়র ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ ও এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। মেয়র হানিফের সঙ্গে তিনি শহর পরিকল্পনার কথা বলেন, তবে সেটি হয়নি। পরে সিপিডি একটি ডায়ালগ আয়োজন করে। সেখানে তখনকার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও চার শহরের মেয়রকে আমন্ত্রণ করা হয়। সেখানে তাদের স্থানীয় পৌরসভাভিত্তিক যেসব উন্নয়নকাজ করা দরকার সেগুলো ভাগ করার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তবে তিনি (রেহমান সোবহান) বুঝতে পারেন, মেয়রদের আসলে কোনো ক্ষমতা নেই কিছু পরিবর্তন করার। সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, “ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনা মূলত আমলাতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। এর কারণ, এখানে সীমানা নির্ধারণে জটিল অধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখানে স্থানীয় সরকারের অধীনে সব। এমনকি স্থানীয় সরকার চাইলে তাদের (মেয়র) বাদও দিতে পারে। তাই প্রকৃত দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতা ব্যবহার করার ক্ষেত্র ঢাকা শহরের মেয়রদের হাতে নেই।”
রেহমান সোবহান বলেন, “এই অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে মনোনীত করার চেয়ে নতুন সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া সাবের হোসেন চৌধুরীকে আনলে ভালো হতো। মন্ত্রী এসব বিষয় শুনে ব্যবস্থা নিতে পারতেন।”
রেহমান সোবহান আরও বলেন, “এখন মন্ত্রীদের এসইউভি গাড়ি দেওয়া হচ্ছে। তার মানে এখন এটি এসইউভি দেশ। যখন বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তাঁর একটি ১৩০০ সিসির টয়োটা প্রাইভেট কার ছিল। আপনার প্রাসঙ্গিক অগ্রাধিকার ও আপনার সামাজিক প্রতিশ্রুতির দর্শন সাধারণত পরিমাপ করা হয় আপনি কীভাবে পরিবহন ব্যবহার করছেন বাস্তবে, তার পরিপ্রেক্ষিতে।”
ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানকার সব জলাশয় ভরাট করা, এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, “এর কারণে এতসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থায়। এখন ৬০ ভাগ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। আমি জানি না, এর মধ্যে কতজন আবাসন উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত।”
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে ১৯৭৪ সালে নগরায়ণের হার ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশে, যা ৫ গুনের বেশি। নগরায়ণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। এখানে নগরায়ণের হার ৩৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এই হার সবচেয়ে কম সিলেটে ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এতে বোঝা যায়, দেশে নগরায়ণের হার অনেক বেশি। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় বাংলাদেশকে নগরকেন্দ্রিক দেশ বলা হবে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ১৯৭৪ থেকে ২০১৭ সময়ে গোটা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক আনুমানিক ১ দশমিক ২ শতাংশ। সে সময় ঢাকা শহরে তা ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ, সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকা শহরে এসে জড়ো হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঢাকা শহরের বাসিন্দা।
আন্তর্জাতিক তুলনায় দেখা যায়, দেশের মোট শহুরে জনসংখ্যার কত শতাংশ বড় বড় শহরে বসবাস করে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশে এই অনুপাত প্রায় ৩২ শতাংশ, যেখানে চীনে মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বড় বড় শহরে বাস করে। ভারতে এই হার ৬ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ।
মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ দেশের সবচেয়ে বড় শহরটিতে বাস করে সে বিবেচনায়ও বাংলাদেশ শীর্ষ দেশের একটি। যেখানে চীনে এই অনুপাত মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা ১১ দশমিক ২ শতাংশ।