কোনো কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের বাজার। ডলারের দর ১০ দিনের ব্যবধানে দুই বারে ৭৫ পয়সা কমানোতে মুদ্রাবাজারে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি হয়নি। এখনও গ্রাহক চাদিহা অনুযায়ী ডলার মিলছে না বলে বাড়তি দরেই রেমিটেন্স আনছে ব্যাংকগুলো।
তথ্য বলছে, গত ২৯ নভেম্বর ডলারের দাম ২৫ পয়সা কমানো হয়েছে। এই দর কার্যকর হয়েছে রোববার (৩ ডিসেম্বর) থেকে। তবে ডলারের দাম কমানোর পরদিন থেকেই বাজারে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। ডলার সংকট মোকাবেলায় কালোবাজারিদের হাত থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের তোরজোড় দেখা গেলেও পুরোপুরি রোধ করতে সক্ষম হয়নি।
পল্টনের ওয়েস্টার্ন মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রয় কর্মী আমিন উদ্দিন জানান, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা ডলার বিক্রি করছেন ১২২ টাকা ৫০ পয়সায়, কিনেছেন ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে। যদিও ডলারের দাম দুই ধাপে ৭৫ পয়সা কমিয়ে ক্রয় ঠিক হয় সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা এবং বিক্রয় দর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু কোথাও এ দরে ডলার পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “একদিকে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় একটা, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে ডলার না পাওয়ায় চাহিদা মেটাতে ছুটতে হয় মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ডলারের দাম নির্ধারণের চেয়ে বেশি।”
তিনি আরও বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী আমরা ডলার কিনতে পারছি না। আমরা ডলার কিনতে না পারলে জনগণের কাছে বিক্রি করবো কিভাবে। বেশি দামেও বাজারে ডলার মিলছে না। ডলারের এই সংকট মোকাবেলা বা উত্তরণের কোনো পথ আমরা সামনে দেখছি না। বলা যায় সংকটময় পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হবে।”
চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যাবেন মো. উজ্জ্বল শেখ। গত দুদিন ব্যাংকে ঘুরেও কোনো ডলার কিনতে পারেননি তিনি। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে ডলার কেনার সিন্ধান্ত নিয়েছেন। তাই এসেছেন মানি এক্সচেঞ্জে। ১২২ টাকা ডলারের দাম হলেও কিনবেন বলে মো. উজ্জ্বল শেখ জানিয়েছেন সংবাদ প্রকাশকে।
তিনি বলেন, “ব্যাংকে ডলার নেই। চাহিদা মতো ডলার কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এখন দেশের বাহিরে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে। দেশের ডলার সংকট এতটাই বেড়েছে যে বেশি দামেও ডলার পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই বাধ্য হয়ে মানি এক্সচেঞ্জে এসেছি বেশি দামেই ডলার কেনার জন্য।”
জানা গেছে, ডলার সংকট মোকাবেলায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার অন্যদিকে ডলারের দাম কমানো হচ্ছে। ডলারের তীব্র সংকটের মধ্যেই এমন কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছর মাত্র সাড়ে চার মাসে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৫.২৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে জুলাই থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলার। এটি ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি ও এক্সচেঞ্জ রেট কমানোর প্রয়োজনীয়তার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লোকাল কারেন্সির মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু ইন্ডিকেটর ফলো করা হয়। আমাদের দেশে এর কোনোটাই নেই। আমাদের রিজার্ভ কমছে এবং মার্কেটে ডলারের লিকুইডিটি ক্রাইসিস আছে।
জানতে চাইলে আইএমএফ-এর সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এটা সত্যি যে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের মতো আমাদের দেশের কিছু ফরেক্স ইন্ডিকেটর ভালো হয়েছে। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, মার্কেটে ডলারের ক্রাইসিস আগের তুলনায় বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাফেদার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের দাম কমানোটা মূলত মার্কেটকে একটা সিগন্যাল দেওয়া যে ডলারের দাম আর বাড়ানো হবে না। অবশ্য, সিদ্ধান্তটি যতটা অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। নির্বাচনের আগে ডলারের দাম আর বাড়তে দিতে চাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
এদিকে ডলার সংকট মোকাবেলায় প্রবাসী আয় ভরসা হলেও নির্ধারিত দামে রেমিট্যান্স না পাওয়ায় বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আন্তঃব্যাংকে ঘোষিত যে দর রয়েছে সে দরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান এ মুদ্রা বিক্রি করছে না কেউ; খোলাবাজারে দাম আরও বেশি, যদিও সেখানে উত্তাপ আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
বেসরকারি ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্টের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “এখনও অনেক ব্যাংক ১২২-২৩ টাকায় রেমিট্যান্স নিচ্ছে। কারণ হচ্ছে তাদের তো কিছু কমিটমেন্ট আছে। নতুন দরের বিষয়ে রোববার দিন শেষে জানা যাবে রেমিট্যান্স কত দরে কেনা হচ্ছে।”