• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মসলার বাজারে ডলারের প্রভাব, ঘোষণা ছাড়াই বাড়ছে দাম


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৪, ০৯:৪৯ পিএম
মসলার বাজারে ডলারের প্রভাব, ঘোষণা ছাড়াই বাড়ছে দাম
মসলার দোকান। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিবছরই দেশের বাজারে মসলার দাম বেড়ে যায়। কিন্তু ঈদের আমেজ শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে সেই চিত্র দেখা গেল। গত কয়েক মাস ধরেই অস্থির মসলার বাজার। গোলমরিচ, জিরা, এলাচসহ অন্যান্য মসলার দাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই বেড়েছে। যেকোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের কঠোর নির্দেশ থাকলেও কোনো নির্দেশই মানছেন না ব্যবসায়ীরা। বলা চলে, সরকারকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। নতুন করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে মসলার বাজারে এলাচের দাম বাড়তির কারসাজিতে আবারও মেতে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি এলাচে বেড়েছে এক হাজার ৬০০ টাকা। এক সপ্তাহে আগে যে এলাচ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৮০০ টাকা, এখন সেই একই এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৩ হাজার ৪০০ টাকা। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানির খরচ বাড়ায় এলাচের দাম বেড়েছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. আলামিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “লোকমুখে শুনলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারে নাকি ৭ টাকা বাড়িয়েছে। ১১০ টাকার ডলার এখন নাকি ১১৭ টাকা। তাই বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখনই আমদানির খরচ বৃদ্ধি দেখিয়ে আমাদের কাছে থেকে এলাচের দাম বাড়তি নিচ্ছেন। এক সপ্তাহে আগে এলাচ এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করেছি, আর এখন একই এলাচ ৩ হাজার টাকা করে কিনতে হচ্ছে, তাহলে বিক্রি করব কত করে? কিছুদিন আগে থেকে নতুন করে মসলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এখানে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই।”

ইমরান নামের আরেক ব্যবসায়ী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এক সপ্তাহে যে মসলা এক দামে কিনে আনি, পরের সপ্তাহে গেলে একই মসলা আবার অন্য দামে কিনতে হয়। দামের সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায় না। যে দামে মসলা কিনতে হয়, তার চেয়ে সীমিত লাভে বিক্রি করতে হয়। এখানে লাভ করে গাড়ি গাড়ি টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

ইমরান আরও বলেন, “ব্যবসায়ীরা বলছেন ডলারের দাম বেড়েছে। তাই খরচ বেড়েছে, দামও বেড়েছে। দুই দিন আগে ডলারের দাম বাড়ল, তাহলে এক সপ্তাহে আগে কেন মসলার দাম বাড়ল? অনেক বড় ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত মসলা মজুত করে রেখেছে। কিছুদিন পর বাজারে ছাড়বে। আপাতত তারা বাজারে সংকট তৈরি করে রেখেছে।”

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ মসলাপণ্য আমদানিনির্ভর। দেশে উৎপাদিত দু-একটি মসলা ছাড়া অধিকাংশ মসলা আমদানি করে চাহিদা পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। কিন্তু মসলাপণ্য আমদানিতে যে অর্থ খরচ হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ খরচ দেখিয়ে পাইকারিতেই এসব পণ্য বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। এছাড়াও মোবাইলের মেসেজের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে দপ্তরগুলো সোচ্চার হলেও কতটুকু সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ; সে প্রশ্ন বরাবরই থেকে যাচ্ছে। নানা সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কথা বললেও ফলপ্রসূ কিছু আসেনি। বরং সর্বত্রই হয়রানি আর ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজির হোসেন বলেন, “সিন্ডিকেটের কারণে বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। নিয়ন্ত্রণ রোধে যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, কোনো পদক্ষেপেই কাজ হচ্ছে না। ফলাফল হিসেবে সিন্ডিকেট থেকেই যাচ্ছে, অস্থিরতাও বাড়ছে।”

এস এম নাজির হোসেন আরও বলেন, “মূলত ভারত থেকে জিরা ও এলাচ, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও গুয়েতেমালা থেকে দেশে লবঙ্গ ও দারুচিনি আমদানি করা হয়। এতদিন এসব দেশে উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাত দেখালেও এখন তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়ে যাওয়া। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।”

শুধু মসলাপণ্য এলাচ নয়। এলাচের মতো জিরা, লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ, জয়ত্রির দামও বেড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি কেজি জিরা ৬৮০ টাকা, লবঙ্গ এক হাজার ৮০০ টাকা, দারুচিনি ৪৫০ টাকা, গোলমরিচ ৯০০ টাকা এবং জয়ত্রি ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা কিছুদিনের তুলনায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২৪ হাজার ২৬৭ মেট্রিক টন এলাচ, ৪১ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন জিরা, ৩২ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন লবঙ্গ এবং ২৯ হাজার ৬৪৬ মেট্রিক টন গোল মরিচ আমদানি হয়েছে। এটি গত বছরের এ সময়ে আমদানির তুলনায় অনেক বেশি। চলতি বছর মসলা পণ্য আমদানি বেশি হওয়ার পরও নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ানোকে নতুন করে সিন্ডিকেট বলে মত দিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

তাদের ভাষ্য, ডলার সংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে অস্থিরতা বেড়েছে মসলার বাজারে। পর্যাপ্ত মসলা মজুত থাকার পরও সংকট তৈরি করে রেখেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ বাজার মনিটরিংয়ে জোর দেওয়া হলেও পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কবল থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।

তেজগাঁও থেকে কারওয়ান বাজারে মসলা কিনতে এসেছিলেন শিহাব সরকার। মসলার দাম শুনে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ালেন তিনি। এরপর তিনশ টাকার মসলা কিনলেন। তবে দাম বেশি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তাকে ব্যবসায়ী জানালেন দাম বাড়ার কারণ যৌক্তিক।

শিহাব সরকার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঈদের আগে বাজারে সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে। নতুন করে মসলার বাজারে সিন্ডিকেট ভর করেছে। গত এক মাসে মসলার বাজারে যেভাবে দাম বেড়েছে যা অস্বাভাবিক। এক হাজার ৮০০ টাকা এলাচের দাম নাকি ৩ হাজার ৪০০ টাকা। এইভাবে যদি মসলার দাম বাড়ে, তাহলে মানুষ কী করে খাবে।”

সরকারের অভিযানের কথা উল্লেখ করে শিহাব সরকার বলেন, “সরকার মাঝেমধ্যেই বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু আমরা কী সুফল পাই, তা জানি না। ডলার সংকট, ডলারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখানো শুরু করেছেন। আবার সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। ঈদের আগে আরেক ধাপ মসলার দাম বাড়বে এটা নিশ্চিত। পুরোপুরি বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”

Link copied!