• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ডলার সংকটে কমেছে হ্যান্ডসেট বিক্রি


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪, ১০:০১ পিএম
ডলার সংকটে কমেছে হ্যান্ডসেট বিক্রি
হ্যান্ডসেট বিক্রির দোকান। ছবি : সংগৃহীত

সুমন মণ্ডল (ছদ্মনাম)। মোবাইল ফোনসেটের ডিলারশিপ রয়েছে তার। মিরপুরসহ রাজধানীর কয়েকটি এলাকার শো-রুমে মোবাইল ফোন সেট সরবরাহ করেন তিনি। ব্যবসার শুরুটা বেশ ভালো গেলেও করোনা মহামারির প্রকোপে হঠাৎই বড় ধাক্কা খান। ব্যবসায় করোনার প্রভাব পরর্ব্তী সময়ে কাটিয়ে উঠতে শুরু করলে নতুন করে আবারও প্রতিকূল পরিবেশে পড়তে হয় তাকে। তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। বেড়েছে ডলারে দাম। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে তার। কমেছে লাভ।

এ প্রতিবেদককে সুমন মণ্ডল বলেন, “ব্যাংক থেকে চাহিদা মতো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। চড়া দামে খোলা বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে। পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এদিকে দাম বাড়ালে বিক্রি কমে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “ডলার সংকট আরও বাড়লে আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তা এক সময় ঝরে পড়বে।”

সুমন মণ্ডল একাই নন, তার মতো অনেকেই ডলার সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন। কারণ দিন যত বাড়ছে, অস্থির হয়ে উঠছে ডলারের বাজার। আর এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্রই। একদিকে ব্যাংকে পর্যাপ্ত ডলার মিলছে না, অন্যদিকে খোলাবাজারে বেশি দামে ডলার কিনেও চাহিদা মেটাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও বাড়তি করের পাশাপাশি ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দেশে মোবাইল ফোন বিক্রি কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে কমেছে স্থানীয়ভাবে তৈরি মোবাইল ফোন সেটের সংখ্যাও।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ২ কোটি ৩৩ লাখ মোবাইল ফোন সেট তৈরি করেছিল। এটি ২০২২ সালে তৈরি করা ৩ কোটি ১৭ লাখ সেটের তুলনায় ২৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম।

তথ্য বলছে, মন্দা এতটাই প্রভাব ফেলছে যে ২০২৩ সালে স্থানীয়ভাবে তৈরি ফোনের সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় আরও কম। ২০২০ সালে ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি হ্যান্ডসেট তৈরি করা হয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে মোবাইল ডিভাইস কম্পোনেন্টের বাজারে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ২০২১ সালে ২ কোটি ৯৫ লাখ হ্যান্ডসেট তৈরি করা হয়েছিল। ২০২২ সালে স্থানীয়ভাবে ৩ কোটি ১৬ লাখ হ্যান্ডসেট উৎপাদিত হয়েছে। এটি আনুষ্ঠানিক স্থানীয় চাহিদার ৯৯ শতাংশ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো মিলে স্থানীয় মোবাইল সেট উৎপাদন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া, এলসি খোলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্যান্ডসেটের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আগের পর্যায়ে না এলে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে বা প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হবে।

সিম্ফনি মোবাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাকারিয়া শাহিদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডলার সংকট বড় প্রকট। সময়মতো এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে অনেক উপকরণ আনা সম্ভব হয় না। সঠিক সময়ে প্রডাকশন সম্ভব হয় না। যেহেতু এখানে ১০০ ভাগ ম্যানুফিচেরিং হচ্ছে, তাই একটা কম্পোনেন্ট মিস করলে বিপদ। ফলে ফ্যাক্টরির প্রডাকশন কন্টিনিউটি যেটা সেটা ব্যাহত হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “ব্যাংকে ডলারের দামের চেয়ে খোলাবাজারে এর দাম অনেক বেশি। তাই ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। সেই সাথে বেড়েছে মোবাইলের দামও। এই সময়ে যে পরিমাণ আমদানির খরচ বেড়েছে, সে তুলনায় মোবাইলের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ দাম বাড়ালে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে মোবাইল। সবমিলিয়ে আমাদের উৎপাদন কমেছে, বিক্রিও কমেছে। এ কথা সত্য যে এখন একটু অস্থিরতা চলছে। এই সময়ে সব ব্যবসায়ীরাই ভালো নেই।”

মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমপিআইওএবি) তথ্যে জানা যায়, গত বছর মোবাইল ফোন বিক্রি কমেছে ৩৩ শতাংশ।

জানা গেছে, ২০২০-২১ সালের আগে মোবাইল ফোন আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর ছিল। স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর কর ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। পরে কারখানা থেকে পরিবেশক হয়ে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত বিক্রির তিন ধাপের প্রতিটিতে পাঁচ শতাংশ ভ্যাটের কারণে তা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই উৎপাদন পর্যায়ে আরও ভ্যাট আরোপ করে রাজস্ব বোর্ড। সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে এমন পণ্যের ওপর প্রথমবারের মতো অতিরিক্ত দুই শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে তৈরি অন্তত দুটি যন্ত্রাংশ দিয়ে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি করা যন্ত্রাংশ দিয়ে সংযোজিত হ্যান্ডসেটের ওপর ভ্যাট পাঁচ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি সেবা ও ডিজিটাল ডিভাইস রপ্তানি করে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর বড় অংশ ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন সেট রপ্তানি থেকে আসে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে করে শিল্প-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান কমছে। ডলার বাজারে অস্থিরতার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ডলার সংকটে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়েছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর এজন্য বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে রেমিট্যান্স কমছে হুন্ডি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে। প্রবাসীরা হুন্ডিতে পাঠালে বেশি দর পান। আবার ব্যাংকের চেয়ে দ্রুত সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। যেখানে কাজ করে সেখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে অর্থ পাঠাতে হয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।”

Link copied!