আহনাফ তাহমিন আয়হাম (১০)। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) খতনা করাতে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সন্তান আহনাফকে নিয়ে যান বাবা ফখরুল আলম। কে জানত এই যাওয়াই তার শেষ যাত্রা হবে। মা-বাবা, সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে কাঁদিয়ে অন্তিম পথযাত্রায় পাড়ি জমিয়েছে আহনাফ। বাবা ফখরুল আলম এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তার ছেলে আর নেই।
জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আহনাফকে সুন্নতে খতনা করানোর জন্য তার বাবা ফখরুল আলম জেএস হাসপাতালের চিকিৎসক এস এম মুক্তাদিরের কাছে নিয়ে যান। তিনি ওই সময় কিছু টেস্ট লিখে দেন। ওই হাসপাতালেই টেস্টগুলো করে ছেলেকে নিয়ে বাসায় চলে যান। রাতে চিকিৎসক ফোন করে জানান, রিপোর্টগুলো ভালো আছে। সুন্নতে খতনা করতে কোনো সমস্যা নেই।
পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ৮টায় ছেলেকে সুন্নতে খাতনা করানোর জন্য স্ত্রী খায়রুন নাহারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হাসপাতালে যান। পরে ছেলেকে অপারেশন থিয়েটার নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানান, তাদের ২০/২৫ মিনিট সময় লাগবে। তখন আহনাফের বাবা-মা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন।
সংবাদ প্রকাশকে দেওয়া ফখরুলের তথ্যমতে, ৩০/৩৫ মিনিট পর ওটি রুমের দরজায় নক করলে তারা জানান আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এভাবে এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর আহনাফের বাবা ফখরুল ওটি রুমে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে নিষেধ করা হয়। আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে বলা হয়। পরে সন্দেহ হলে ফখরুল জোর করে ওটি রুমে প্রবেশ করেন। সেখানে দেখতে পান, তার ছেলে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছে এবং নাকে ও মুখে নল দিয়ে রক্ত বের হওয়া অবস্থায় দেখেন। তখন চিকিৎসক এস এম মুক্তাদিরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সঠিক উত্তর দেননি।
স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয় আহনাফকে। যে কারণে তার আর জ্ঞান ফেরেনি।
ছেলে আহনাফের মরদেহ গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা নেওয়ার পথে মোবাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশকে ফখরুল বলেন, “আমার ছেলেকে দেখতে সার্জারি করার ৩০ মিনিট পর্যন্ত তারা আমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। পরে মিনিমাম ৪৫ মিনিটের মাথায় আমি আমার এক সহকর্মীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। দেখি আমার সন্তান অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালের বেডে। হাতে নীল রঙের মতো দাগ হয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম হাতে দাগ কেন? তারা আমাকে উত্তরে বলেছে, ফুসফুসে পানি জমেছে। তারা নাকি কাজ করছে ১০-১৫ মিনিটের মাথায় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ছেলে ওইযে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল, আর উঠে আমাকে বাবা বলে ডাকিনি।”
ঘটনার বিবরণ জানিয়ে ফখরুল বলেন, “তারা আমার ছেলেকে এড্রিল না কি যেন দিচ্ছেন। এটা লাইফ সাপোর্টের জন্য দেওয়া হয়। এটা দিচ্ছেন এবং সাকসেশন করছেন। এড্রিল দিলেও আমার ছেলের পার্লস বাড়ে, আবার এড্রিল পুশ করার পর পার্লস শেষ, এক মিনিটের ভেতরে পার্লস ওঠে না। ৪০, ৪৫, ৫০ থেকে ৭০ ওপরে আর ওঠে না। যেখানে ১০০ থাকার কথা। এরা আসলে কৃত্রিমভাবে আমার ছেলেকে এই রকম করে রাখছে। এইভাবে করতে করতে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় চলে গেছে। তখন আমি তাদের বলেছি কিছু বলার জন্য। কী হয়েছে আমার ছেলের। তারা আমাকে জানিয়েছেন আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল আলম বলেন, “ডাক্তারের গাফিলতির কারণেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি ডাক্তারকে হাতে পায়ে আকুতি করে বলেছি কোনোভাবেই ছেলেকে অ্যানেন্থেশিয়া করাবেন না বা ঘুম পারাবেন না। লোকালে করাবেন। এক সপ্তাহে আগে আমার স্ত্রী গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথাও বলে আসছে। ডাক্তার তখন বলেছেন লোকাল দিয়েই করাবেন। কিন্তু আমি লোকালে করার কথা বললে ডাক্তার আমাকে অ্যানেস্থেসিয়া করার কথা জানান।”
ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ আপনার কী কথা হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, “ছেলেকে তো ওটিতে ঢুকিয়ে দিলাম। ও বলছিল একটু ভয় লাগছিল। আমি বলেছিলাম, বাবা কোনো সমস্যা নেই, আল্লাহ ভরসা। এরপর ওটিতে ঢুকল, আর সব শেষ। আমার ছেলে খুব উৎফুল্ল মনে ওটিতে ঢুকেছিল, খুব উৎফুল্লভাবে। তার খতনা করানো হবে, এতে সে খুব খুশি ছিল।”
তথ্যমতে, এ ঘটনায় সকালে আহনাফ তাহমিন আয়হামের বাবা বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ডায়াগনন্টিক সেন্টারটি বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার জন্য হাসপাতালের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই হাসপাতালের শুধুমাত্র ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন আছে। যে কারণে তাদের অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, “আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শিশু আহনাফের মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা জেনেছি সামান্য একটা মুসলমানির জন্য শিশুটিকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ডা. ইশতিয়াক নামক একজন এই খতনার সার্জন ছিলেন। আর ডা. মাহবুব মুর্শেদ শিশুটির অ্যানেস্থেসিওলজিস্টস ছিলেন। অভিযোগ অনুসারে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার সময় শিশুটিকে অজ্ঞান করার পর আর তার জ্ঞান ফেরেনি। পরে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পেরেছি। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিষ্ঠানটিতে তালা মারা হয়েছে।”
মইনুল আহসান আরও বলেন, “হাসপাতালটির সব তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করছি। যতটুকু পেয়েছি, প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতাল কার্যক্রম চালানোর কোনো অনুমোদন ছিল না। তবে তাদের ডায়াগনস্টিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে। সুতরাং তারা যদি কোনো রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে থাকে, সেটি অন্যায় করেছে। আমরা আরও তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেব। আর যিনি অপারেশন করেছেন, তার বিরুদ্ধে আমরা আমাদের আইনানুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।”