একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলটির দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপির এবারের এক দফা দাবি ও ঘোষিত কর্মসূচি নিয়েও চলছিলো নানা আলোচনা-সমালোচনা। তবে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে সমাবেশটি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এক দফা দাবির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল ছিলো তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। তারা ভেবেছিলো কেন্দ্র থেকে আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। তৃণমূলের এই ধারণা সত্যি হয়নি, প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি দলটির হাইকমান্ড।
সিনিয়র নেতাদের দাবি, এক দফা দাবি আদায়ে আমরা এখন প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সংঘাত চাই না, শান্তিপূর্ণভাবে ধাপে-ধাপে কঠোর আন্দোলনের ডাক দিবে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এদিকে বিএনপির ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের মাঝেও ঘোষিত কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূলের মতো হতাশা তৈরি হয়েছে। তারাও মনে করছেন, এরকম নরম কর্মসূচি দিয়ে বর্তমান সরকারের পতন সম্ভব নয়। সরকারের পতন ঘটাতে হলে দরকার কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি।
মতিঝিল থানা বিএনপি’র নেতা মো. ফরহাদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘দেখেন চলতি বছর দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন দাম, অথচ জনগণের এমন ক্ষোভ সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাজে লাগাতে পারিনি আমরা।’ ‘নেতাকর্মীরা দলের আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েও হতাশায় আছে। সাধারণ মানুষ চায়, বিএনপি জনগণের দাবি নিয়ে রাজপথে সরব থাকুক, তাই দেখতে চায় সাধারণ মানুষ।’ ক্ষুদ্ধ এই নেতা আরও বলেন, ‘গতকালকের সমাবেশ থেকে এক দফা দাবি আদায়ে ভাবছিলাম হরতাল অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিবে দল। কিন্তু আমরা সে ধরনের কিছু দেখতে পাইনি। এক দফার দাবি নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে যে উত্তেজনা ছিলো মহাসচিবের কর্মসূচি ঘোষণার পর তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা রওনক জাহান শাহিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিকতা রেখে সুশৃঙ্খলভাবে আগাচ্ছি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ সম্পন্ন করেছি। এই সমাবেশে শুধু বিএনপির কর্মীরাই ছিলেন না, সারা বাংলাদেশের অধিকার-বঞ্চিত মানুষের উপস্থিতিও ছিল অনেক।’
‘কর্মসূচি নিয়ে অনেকের মাঝে হতাশা যেমন আছে তেমনি আমার মাঝেও আছে। হতাশার মাঝেও আমরা অনেক উজ্জীবিত। আমরা আশাবাদী, যতক্ষণ পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে, ততক্ষণ আমরা মাঠে আছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাড্ডা থানা যুবদল নেতা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘অনেকে ভেবেছেন এবারের সমাবেশ থেকে চূড়ান্ত এবং কঠোর আন্দোলনের ডাক দিবে বিএনপি। কিন্তু না, কঠোর আন্দোলনের বদলে আবারো সেই পদযাত্রা কর্মসূচি। আমরা অবাক হয়েছি।’ যুবদলের এই নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ভাবতে হবে আওয়ামীলীগ সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায়। তারা বিগত সময়ের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের সাথে জনগণ নেই, কিন্তু পুলিশ প্রশাসন আছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে ধীর গতিতে আন্দোলনে যাচ্ছি, তাতে কি হবে আমাদের জানা নেই।’
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সস্পাদক আবদুল কাদের সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘গতকালকের সমাবেশে সবাই নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছে। অনেকে কাফনের কাপড় পরে এসেছে। কিন্তু এক দফা দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি না পেয়ে মহাসচিবের বক্তব্যে দারুণভাবে আশাহত হয়েছি আমরা সকলে। এ সরকাকে সরাতে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
নোয়াখালী জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নরুল আমিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘বিএনপির কর্মীরা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়েও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। দলের চেয়ারপার্সন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলীয় কার্যক্রমে সরাসরি না থাকলেও কেউ মনোবল হারাননি। প্রতিনিয়ত আমাদের কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের উপস্থিতি বাড়ছে। সাধারণ মানুষ চায়, বিএনপি কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিবে, তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।’
আন্দোলনের ধাপ নিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানবীর আহমেদ রবিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘প্রতিটি আন্দোলনের একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছি। সেটি ছিল একটি পর্যায়ের আন্দোলনের শেষ ধাপ। আমাদের মহাসচিব আগেই বলেছিলেন ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ শেষ কর্মসূচি নয়; বরং একটি ধাপের শেষ কর্মসূচি। তারপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা গতকাল বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে এক দফা দাবি ঘোষণা দিয়েছি। সেই সাথে দাবি আদায়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে।’ কর্মসূচি ঘিরে তৃণমূলের হতাশা নিয়ে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘বিএনপি সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বড় দল। একেকজন চাইবে একেকভাবে সরকারের পতন ঘটাতে। কিন্তু আমাদের সবাইকে মাথায় রাখতে হবে সরকার পতনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে গতকাল। আমরা ধীরে ধীরে কঠোর আন্দোলনে যাবো। আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
নেতাকর্মীদের হতাশা ও দিক-নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগে ১০ দফা দাবি দিয়েছি। তারপর রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছি। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এক দফা ঘোষণা করেছি। এক দফাতে স্পষ্ট আমরা কি চাই। তারই ধারাবাহিকতায় অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ অনেক সময় আবেগ নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু রাজনীতিতে আবেগের জায়গা নেই। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। বিএনপি সংঘাত চায় না। তাই আমরা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছি। রাজনীতিতে সময় বেঁধে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, পরিস্থিতি বলে দেয় কখন কীভাবে আগাতে হবে ‘