ঈদের আগে টিকেট কালোবাজারি ঠেকাতে অভিযানে নেমে ‘ঢালী সিন্ডিকেটের’ নয় সদস্যকে আটক করেছে র্যাব। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের অন্তত তিন হাজার টিকিট হাতিয়ে কালোবাজারে বিক্রির পরিকল্পনা ছিল এই চক্রের।
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) রাতে টিকেট কালোবাজারিদের ধরতে রাজধানীর কমলাপুর ও সবুজবাগ এলাকা অভিযান চালানো হয়।
এ সময় দীর্ঘ নজরদারির পর জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সহায়তায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্র ‘ঢালী সিন্ডিকেটের’ হোতা ও সহজ ডটকমে কর্মরত সার্ভার অপারেটরসহ নয়জনকে আটক করে র্যাব-৩।
আটকরা হলেন সিন্ডিকেটের মূলহোতা মিজান ঢালী (৪৮), সোহেল ঢালী (৩০), সুমন (৩৯), জাহাঙ্গীর আলম (৪৯), শাহজালাল হোসেন (৪২), রাসেল (২৪), জয়নাল আবেদীন (৪৬), সবুর হাওলাদার (৪০), ও নিউটন বিশ্বাস (৪০)। এদের মধ্যে নিউটন সহজ ডটকমের কমলাপুর রেলস্টেশন সার্ভার রুমের সার্ভার অপারেটর।
এ সময় তাদের কাছ থেকে আটটি মোবাইল ফোন, একটি এনআইডি, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স, কালোবাজারির বিভিন্ন আলামত এবং টিকেট বিক্রির নগদ ১১ হাজার ৪২২ টাকা জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, চক্রটিকে টিকিট পেতে তথ্য দিয়ে প্রধান সহায়তা করতেন সহজের নিউটনসহ অন্যরা। সাধারণত রেলওয়ের দুই ভাগ টিকিট জরুরি প্রয়োজনে সংরক্ষিত রাখা হয়। যাত্রা শুরুর ১২ ঘণ্টা আগে সেই টিকিটগুলোর ব্লক খুলে সাধারণদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
আবার কেউ কেউ টিকিট কাটতে গিয়ে সার্ভার জটিলতা বা মোবাইল ব্যাংকিং জটিলতায় পেমেন্ট সম্পন্ন করতে পারেন না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পেমেন্ট সম্পন্ন না করতে পারলে সেসব বুকিংও বাতিল হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে সার্ভার রুম থেকে কখন টিকিট ছাড়া হচ্ছে, কখন ব্লক করা হচ্ছে, কখন ব্লক খোলা হচ্ছে, তাৎক্ষণিক তথ্যগুলো সরবরাহ করা হতো। তখনই চক্রের সদস্যরা অনলাইনে অথবা সখ্য থাকা কাউন্টারম্যানদের সহায়তায় তাদের কাছে থাকা এনআইডি দিয়ে টিকিটগুলো সংগ্রহ করে নিত।
র্যাব আরও জানায়, ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিন ঘিরে মিজান ও সোহেল কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ সময়ের তুলনায় বেশি টিকিট সংগ্রহ করতেন। মিজান ও সোহেল প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের সহজের কর্মচারী ও কাউন্টারম্যানদের মাধ্যমে প্রায় দুই-তিন হাজার টিকিট কালোবাজারির মাধ্যমে বিক্রি করত। তারা আসন্ন পবিত্র ঈদে আগের চেয়েও বেশি সংখ্যক টিকেট সংগ্রহের পরিকল্পনা করছিলেন।
সংগ্রহ করা টিকিট দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করত চক্রটি। বিক্রির টাকার অর্ধেক সহজ ও রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট কাউন্টারম্যানরা পেতেন এবং বাকি অর্ধেক মিজান, সোহেলসহ বাকি বিক্রয়কারী ও সহযোগীদের মধ্যে ভাগাভাগি হতো।
এ অর্থ কখনো তারা নগদ হাতে-হাতে বুঝিয়ে দিতেন, আবার কখনো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করতেন। সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্য অবৈধভাবে ট্রেনের টিকিট বিক্রি করে প্রতি মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করতেন।
পিয়ন থেকে টিকিট কালোবাজারি চক্রের হোতা মিজান
দীর্ঘদিন ধরে মিজানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সব ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হচ্ছিল। মিজান ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিংয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
২০০৩ সালে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ডেফোডিলের কমলাপুর রেলস্টেশন শাখায় পিয়ন হিসেবে যোগ দেন মিজান। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিংয়ে সিএনএস ডটবিডির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে অভিজ্ঞ কর্মী হিসেবে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল রাখা হয়।
সর্বশেষ ২০২০ সালে রেলওয়ে টিকিটের চুক্তি সহজ ডটকমে দেওয়া হলে সেখানেও মিজানের চাকরি বহাল থাকে। দীর্ঘদিন টিকিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের সহজ ডটকমের অফিসে এবং বড় বড় রেলওয়ে স্টেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে তার পরিচিতি বাড়ে।
এ পরিচয়ের সূত্র ধরেই বিভিন্ন স্টেশনে থাকা সহজ ডটকমের সদস্য, টিকিট কাউন্টার ও অন্য কালোবাজারি চক্রের সদস্যদের সমন্বয়ে কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টিকেট বিক্রি করে আসছিলেন মিজান ঢালী।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিভিন্ন সময় অনলাইনে টিকিট কাটার চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন হলেও পুরোনো কর্মচারীরা থেকে যাচ্ছেন। নতুন প্রতিষ্ঠানে চুক্তির সময় ৮০ ভাগ পুরনো কর্মী চাকরিতে বহাল রাখার নিয়মের কারণে তারা থেকে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন চাকরি করার কারণে স্টেশনের অন্যান্য মানুষ তথা চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থেকে যাচ্ছে। তারাই বিভিন্ন তথ্য দিয়ে চক্রের সদস্যদের সহায়তা করে আসছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা রেলওয়ের অনেকের বিষয়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তথ্য দিয়েছি। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেকের বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দারাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দারা কাজ করছেন। ঊর্ধ্বতন কারও টিকিট কালোবাজারিতে সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, গোয়েন্দারা যাচাই করে দেখছেন।”
তিনি আরও বলেন, “টিটি, কাউন্টারম্যান, রেলওয়ের সিনিয়র কিছু কর্মকর্তার তথ্য আমরা পেয়েছি। তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ সিন্ডিকেটে ঠিক কতজন জড়িত, এর সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়।”