অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এরমধ্যে চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ পেরিয়েছে। মৃত্যু প্রায় ৫০০ এর কাছাকাছি। তার মধ্য শুধু রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা নিয়েছেন ৮ হাজার ৪৭ জন। এখনো হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩৬৬ জন রোগী।
২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৫ জন। কিন্তু ২০২১ সালের সংখ্যাটিও কম নয় (২৮ হাজার ৪২৯ জন)। ২০২২ সালে আবারও ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপে ফিরে আসে। ওই বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন। চলতি বছরের আগস্টের ২১ তারিখ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ২ হাজার ১৯১ রোগী। আর মৃত্যু হয়েছে ৪৮৫ জনের। দৈনিক আক্রান্তের যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিচ্ছে তাতে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতায় রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চাপ বেশি ছিল। হাসপাতালটিতে প্রতিদিন শতাধিকের ওপরে রোগী ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। তাই এতে মৃত্যুও বেশি হয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গুভীতির মধ্যে বৈরী আবহাওয়ার কারণেও জ্বরে আক্রান্তের হার বাড়ছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবারে কেউ না কেউ জ্বরে ভুগছেন। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রাজধানীতে হলেও এ বছর তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। পরিস্থিতি দিন দিন আরও নাজুক হচ্ছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননের সঙ্গে বৃষ্টি ও তাপমাত্রার সম্পর্ক রয়েছে। মে-জুনে বৃষ্টিপাত বাড়তে শুরু করে এবং তাপমাত্রা বেশি থাকায় এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটে।
প্রতি বছর এ সময়ে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে। কিন্তু চলতি বছর মে-জুলাইয়ে বিগত কয়েক বছরের এই সময়ের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডে এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডে মোট ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে জরিপ করেছে তারা। এর মধ্যে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গু এখন ধরণ পাল্টে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মানুষের আচরণের কারণে এডিস মশা নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়েছে। মশার পরিবর্তিত আচরণ জেনে যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং তার প্রয়োগ করা যায় তখনই এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। না হলে যেমন আক্রান্ত বাড়বে, তেমনি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে।”
মুগদা হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গু সব সময়ই হয়। যেহেতু এখন বৃষ্টি বেশি হচ্ছে তাই ডেঙ্গুর বিস্তৃতি বেশি। পাশাপাশি হয়তো আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে পারছি না। একই সঙ্গে অনেকের ভেতর সচেতনতার অভাব আছে। সিটি করপোরেশনসহ ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে।”
নিয়াতুজ্জামান আরও বলেন, “আমাদের হাসপাতালে অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় রোগী ভর্তির সংখ্যা বেশি। অতিরিক্ত রোগীর ভর্তির পরেও চিকিৎসা নিতে আমাদের আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। এরমধ্যেও সবাইকে চিকিৎসা দেওয়ার শতভাগ চেষ্টা আমরা করছি।”