প্রায় ১৩ বছরের অপেক্ষার পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অবশেষে পেশাগত কাজে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পেলেন।
রোববার (২৪ নভেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অস্ত্র সংগ্রহ ও ব্যবহারের নীতিমালা অনুমোদন করেছে। তবে গুলি করার ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম মেনে চলতে হবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে সুরক্ষিত অস্ত্রাগার না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে জেলা পুলিশ লাইনস বা সংশ্লিষ্ট থানার অস্ত্রাগারে।
নীতিমালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক থেকে উপপরিচালক পর্যায়ের ৫৭৯ জন কর্মকর্তাকে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, যত দূর সম্ভব ন্যূনতম বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। তাতে কাজ না হলে দু-একটি গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। কোনোভাবেই প্রথমে দুটি ফাঁকা ও সরাসরি একটির বেশি গুলি চালানো যাবে না। নীতিমালায় বলা হয়েছে, অধিদপ্তরের উপপরিচালক (৯০), সহকারী পরিচালক (৯৩), পরিদর্শক (১৮৬) এবং উপপরিদর্শক (২১০ জন), মোট ৫৭৯ জন ৯ মিমি সেমি অটোমেটিক পিস্তল টি-৫৪ ব্যবহার করবেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি খুবই দরকার ছিল। কারণ, মাদকসংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা বেশির ভাগই সশস্ত্র ও বেপরোয়া হয়ে থাকে। তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে অধিদপ্তরের নিরস্ত্র কর্মী হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সাধারণত অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কিন্তু জরুরি অবস্থায় সব সময় প্রয়োজনীয় মাত্রায় সহযোগিতা পাওয়া নিশ্চিত নয়। এ কারণে অনেক দিন ধরে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ চেয়ে আসছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক (ডিডি) জিল্লুর রহমান বলেন, “অধিদপ্তরের জন্য এই অস্ত্র খুব প্রয়োজন ছিল। মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের জন্য সরকারের এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।”
কর্মীদের দায়িত্ব পালনের সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পেতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চেষ্টা শুরু হয় সেই ২০১১ সালে। এর বেশ কয়েক বছর পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও সময় নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার বছর। অবশেষে ২৪ নভেম্বর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
নীতিমালায় যা বলা হয়েছে
অভিযানে অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বিশদ বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও কোনো কর্মকর্তা কাউকে সরাসরি লক্ষ্য করে একটির বেশি গুলি চালাতে পারবেন না। আগে আকাশের দিকে দুটি ফাঁকা গুলি করা যাবে। পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী গুলি ব্যবহারের তদন্ত হবে। নীতিমালায় গুলিবর্ষণের বিষয়ে অবশ্যপালনীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযানে সরকারি সম্পত্তি রক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গুলি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ফাঁকা গুলি করা এবং সরাসরি গুলি করার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে মাদক কারবারিকে লক্ষ্য করে কোমরের নিচে, অর্থাৎ পায়ে একটি গুলি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা মাদক কারবারে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী বা অস্ত্র বহনকারী ব্যক্তিকেই নিশানা করবেন। গুলিতে কেউ আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, গুলি যেন কোনোক্রমেই পাশের অন্য কাউকে আঘাত না করে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবে সেনা সদর দপ্তর। আর অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসারের প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
গুলিবর্ষণ বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার যুক্তিযুক্ত হয়েছে কি না এবং সরকারি বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করতে হবে। পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট পিআরবির প্রবিধান ১৫৭ অনুযায়ী সে তদন্ত হবে। এভাবেই র্যাব ও পুলিশের গুলি ব্যবহারের পর বিভাগীয় নির্বাহী তদন্ত হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কর্মকর্তারা এই অস্ত্রের যথাযথ ব্যবহার করলে তা মাদক নিয়ন্ত্রণে বড় সহায়ক হতে পারে। কিন্তু কোনো অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ উদ্দেশ্যে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইলে হিতে বিপরীত হবে। তখন আমাদের আরও ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিষ্ঠুর গল্প শুনতে হবে।’