• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
গাছ লাগাবো কোথায়?

কংক্রিট গিলে খেয়েছে ঢাকার সবুজ


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ০৯:৫০ পিএম
কংক্রিট গিলে খেয়েছে ঢাকার সবুজ
ঢাকা মহনগরী। ছবি: সংগৃহীত

তীব্র দাবদাহে পুড়ছে সারাদেশ। বিশেষ করে রাজধানীতে অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। তবে গাছ লাগানোর বদলে নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস করে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন।

তবে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে নগরবাসীকে বাঁচাতে নতুন করে গাছ লাগানোর আন্দোলন শুরু করার তাগিদ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্বপনা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি সামাজিক সংগঠনও গাছ লাগানোর কথা বলছে।

তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ঢাকায় গাছ লাগানোর জায়গাই তো নেই। খেলার মাঠ, পার্কের বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। সড়কের ফুটপাত বা ফাঁকা জায়গাও অবশিষ্ট নেই। সবই কংক্রিটের আস্তরণে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, এক সময়ের সবুজে ঘেরা ঢাকা এখন কংক্রিটের শহরে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংস করে নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় দালানকোঠা। বিভিন্ন সড়কে নগরীর সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলা বড় বড় গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। খেলার মাঠ দখল করে, গাছ কেটে করা হচ্ছে নগরউন্নয়ন। এসব কর্মকাণ্ডে সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস ও হ্রাস পাওয়ায় অসহনীয়ভাবে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।

গাছ কেটে সৌন্দর্য বৃদ্ধি

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বিপদে পড়লেই বাহবা কুড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা অর্গানাইজেশন বের হয়। এর আগে অনেক সংগঠন গাছ লাগিয়েছে সেই গাছগুলো কোথায়? ঢাকা শহরে নতুন করে গাছ লাগানোর জায়গা কোথায়? পার্কগুলো কিংবা খোলা জায়গায় যে গাছগুলো ছিলো সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। আপনি আবার নতুন করে বলেন যে গাছ লাগানোর কথা। খেলার মাঠ দখল করা হয়েছে। সেগুলো তো দখলমুক্ত করা হয়নি। যেখানে সেখানে ফাঁকা জায়গা উন্নয়নের নামে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফুটপাতে কংক্রিট বসানো হয়েছে। তাহলে নতুন করে গাছ কোথায় লাগাবে।”

আলমগীর কবির আরও বলেন, “ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে এতগুলো গাছ কেটে ফেলা হলো, বিপরীতে লাগানো হলো ফুলের গাছ। একটা গাছ বড় হতে দশ থেকে পনেরো বছর লাগে। গাছ লাগিয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাবো, তা নয়। এটা বুঝতে হবে। আপনি গাছ কেটে এখন বলছেন গাছ লাগানোর কথা। তাহলে ফাঁকা জায়গা ভরাট করে ভবন নির্মাণে বাধা দেওয়া হলো না কেন। আসলে এটা সাধারণ মানুষের সাথে তামাশা ছাড়া কিছুই নয়।”

তথ্যমতে, যেকোনো পরিবেশবান্ধব শহরে ২৫ ভাগ বনায়ন বা গাছপালা থাকা প্রয়োজন। তাহলে সে শহরে নির্মল বায়ু ও তাপমাত্রা অনুকূলে থাকবে। তবে ঢাকা শহরে গাছপালা রয়েছে ২৫ ভাগের মাত্র ৯ ভাগ। যা খুবই সামান্য। এই ৯ ভাগ বনায়ন দিয়ে ঢাকার নির্মল বায়ু কিংবা শহরের তাপমাত্রা অনুকূলে আনা সম্ভব নয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকার খেলার মাঠগুলোতে গাছ লাগানোর কথা বলা হলেও সেগুলোর ৭০ ভাগই দখলদারদের কবলে। দখলমুক্ত করতে অনেকটাই ব্যর্থ সিটি করপোরেশন। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে হলে খোলা জায়গায় কিংবা অব্যবহৃত জায়গায় গাছ লাগানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন পরিবেশ বিভাগে পড়াশোনা করা অনেক শিক্ষার্থী।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম শেখ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’, এমন বাণী হারিয়ে গেছে। পরিবর্তে ‘গাছ কাটুন, পরিবেশ ধ্বংস করুন’ বাণী প্রচলিত হচ্ছে। একটা সময় ঢাকার নির্মল বায়ুতে নগরবাসী বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। কিন্তু এখন বাতাস এত দূষিত যে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা প্রথম স্থান পায়। এই দায়ভার সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।” ইব্রাহিম শেখ আরও বলেন, “গাছ লাগানোর প্রকৃত সময় এখন না। শীতকাল কিংবা বর্ষাকালে গাছ লাগানো যেতে পারে। এখন যে গরম, পরিচর্যার অভাবে গাছ মরে যাবে। তাই এমন দায়সারা কাজ আমরা চাই না।”

গাছ কেটে সৌন্দর্য বৃদ্ধি

উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জুবায়ের সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “হাতিরঝিল, বাহাদুর শাহ পার্কের মতো জায়গায় বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ লাগানোর বদলে কাটা হয়। উন্নয়নের চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে নগরীর মানুষ কিভাবে সুস্থ থাকবে সেই চিন্তা দরকার। নগর উন্নয়ন করে কী হবে যদি নগরীর মানুষই বাঁচতে না পারে।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরেই দেশে গরম বেড়ে চলছে। ভাঙছে তাপমাত্রার আগের সব রেকর্ড। ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় পাবনার ঈশ্বরদীতে। ১৯ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে বছরের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

গেল বছরের ৪ এপ্রিল থেকে টানা ১৯ দিন তাপপ্রবাহ ছিল দেশে। এবার ১৬ মার্চে প্রথম চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও কক্সবাজারে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ১৯ মার্চ তা দূর হয়ে পরে ৩১ মার্চ থেকে রাজশাহী ও পাবনা জেলায় ফের তাপপ্রবাহ শুরু হয়। সেই তাপপ্রবাহ এখন পর্যন্ত চলছে। গত ২০ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় যশোরে। ওইদিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় এখনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির ওপরে। যদিও ঢাকায় কিছুটা কমেছে।

চলমান দাবদাহের এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে গাছ কেটেও ফেলা হচ্ছে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় চলমান গাছ কাটা নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন কিংবা জলবায়ু নিয়ে কাজ করা কর্মীরা সোচ্চার হলেও গাছ কাটা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগরের দাবদাহ আসলে অনুভবের বিষয়। অনুভবের তীব্রতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে। যেমন- হাতিরঝিলে গাছের নিচের তাপমাত্রা আর সরাসরি সূর্যরশ্মির নিচে দাঁড়িয়ে তাপমাত্রা অনুভব এক হবে না। তার মানে অনুভবটা তাপমাত্রার সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয়। অনুভবটা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গেও জড়িত। সেই পারিপার্শ্বিকতাকে চার দশক ধরে ধ্বংস করা হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গাছ কোথায় লাগাবে? যখন প্রয়োজন হবে গাছ পেটের মধ্যে লাগাবে। আপনাকে আগে বুঝতে হবে আপনার গুরুত্ব কী। আপনি বাঁচতে চান নাকি মরতে চান। ক্রমাগতভাবে সড়ক প্রসারিত করা হবে এই বুদ্ধি কে দিয়েছে? যানজট কমার জন্য সড়ক প্রসারিত করা হয়েছে কিন্তু যানজট কমেনি। আমরা গাছ লাগানোর একটি নীতিমালা সিটি করপোরেশনে দাখিল করেছি। এই নীতিমালা কার্যকর করার জন্য গত তিন বছরে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তাহলে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্যা সমাধান করতে চায় না সংশ্লিষ্টরা।”

স্থপতি ইকবাল হাবিব আরও বলেন, “সংশ্লিষ্টরা মনে করেন তাদের পুঁজি, তাদের বাণিজ্য, তাদের লোভ এটা থাকবে অগ্রাধিকার, তারপর অন্যগুলো। এইভাবে তো ঔষুধ না খেয়ে অসুস্থ থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই। যেখানে বড় বড় গাছ ছিলো সেগুলো কেটে ঘাস লাগানো হচ্ছে। কেন সেখানকার গাছগুলো কাটতে হবে? কেন বসুন্ধরায় গাছ কাটা হচ্ছে? কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গাছ কেটে কেটে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে? গাছ রেখেও যে কাজ করা যায় তা আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়েছি।”

খামারবাড়ির কথা উল্লেখ এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, “আমাদের এই খামারবাড়ি সড়কটি গাছের ছায়ায় পরিপূর্ণ ছিল। সেটি এখন সম্পূর্ণ কংক্রিটে ঢাকা। এই যে আমরা পরিবর্তন করে ফেললাম, তার বদলে আমরা আচ্ছাদনের কোনো জায়গা তৈরির কথা ভাবিনি। ছায়া মিললেই আবার তাপমাত্রা থেকে রেহাই মিলবে তাও নয়। কংক্রিটের ছায়া থেকে আপনি ঠিক তীব্র তাপমাত্রাই অনুভব করবেন। সহনীয় তাপমাত্রা অনুভব করতে হলে আপনাকে গাছের ছায়ায় যেতে হবে।”

Link copied!