ইউসুফের বয়স ১৭ বছর। পরিবারে সে ছাড়াও মা, এক ভাই আর এক বোন আছে। বাবাও আছে, তবে তাদের সাথে থাকে না। ছেড়ে চলে গেছে। মা রেললাইনের পাশে পিঠা বিক্রি করে। পিঠা বিক্রির আয়ে আগে সংসার কষ্ট করে চালাতে পারলেও করোনার লকডাউনে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিবারের হাল ধরে ইউসুফ। ঠান্ডা পানীয় কোম্পানির পণ্য দোকানে দোকানে পৌঁছায় ভ্যানে করে। সারাদিন ভ্যান টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। তারপর ২০ লিটারের একেকটা প্যাকেট ভ্যান থেকে নামিয়ে দোকানে দেয়।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কথা হয় ইউসুফ ও তার মায়ের সঙ্গে। ইউসুফের মায়ের দাবি, ছেলের বয়স ১৭। কিন্তু দেখলে কেউ কোনোভাবেই ১৫’র বেশি বলে মনে করবে না।
বিশেষজ্ঞদের মত, হয়ত ইউসুফ ১৭ বছরেরই। কিন্তু ভারি বস্তা বহনের কারণে ও অপুষ্টিতে সে ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারেনি।
স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে কি না জানতে চাইলে ইউসুফ বলে, “ইচ্ছা তো করেই। আমার সাথেরগুলো এইট-নাইনে পড়ে। দেখলে তো যাইতেই মন চায়। কিন্তু স্কুলে গেলে তো আর কাজ করা যাবে না।”
একবছর ধরে তেজগাঁওয়ের তারকাটা ফেক্টরি নামে পরিচিত এক কারখানায় কাজ করছে ১৩ বছর বয়সী নবী হোসেন। পড়ালেখা ভালো লাগে না বলে কাজ শিখতে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে তার বাবা-মা। এখানকার কাজ কষ্ট লাগলেও সে এখানেই কাজ করছে। এমন ঘটনা দেখা গেছে একাধিক শিশুর ক্ষেত্রে। লেখাপড়ার প্রতি অনীহা তাদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দেখা যায়, চারপাশে এরকম আরো হাজার হাজার শিশু আছে যারা বিভিন্ন কারখানায় নানান রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়জিত। তবে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ মতে বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ও ১৮ বছরের কম বয়সীদের ঝুকিপূর্ণ কাজে লাগানো বেআইনি। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। অথচ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
যে বয়সে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে হেসে-খেলে স্কুলে কাটানোর কথা, জীবিকার তাগিদে আজ সেই বয়সে কোমলমতি শিশুরা মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন বাস্তবতায়। যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-কলম, সেই বয়সেই হাতে তুলে নিচ্ছে কঠোর শ্রমের হাতিয়ার। ফলে পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়।
ঝুকিপূর্ণ কাজে শিশুরা কী ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে জানতে চাইলে নিবেদিতা স্পেশালাইজড শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. খলিলুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক এই দুই ধরণের সমস্যা হতে পারে। অনেক ভারি ও শক্ত কাজ করার ফলে শিশুর যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেটা হয় না। আবার নানা রকম রোগ হতে পারে।
এই শিশু বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “শিশুরা যখন ওয়েল্ডিং-এর কাজ করে কিংবা তাপ বের হয় এমন জায়গায় কাজ করে, তখন তার চোখের ক্ষতি হতে পারে। কিংবা কোনো রাসায়নিক কারখানায় কাজ করলে তাদের ত্বকের, ব্রেনের ক্ষতি হতে পারে। প্রথমত ত্বকে আলসার, পরে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে অনেক শিশুর। আর কাজ করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বড় ধরণের দুর্ঘটনার স্বীকার হতে পারে।”
শিশুশ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২২টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ গঠন করা হয়।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এটি মঙ্গলকাব্যের বিখ্যাত চরিত্র ঈশ্বরী পাটনির চাওয়া। পাটনী সন্তানের মঙ্গল ও সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা থেকেই দেবীর কাছে উক্তিটি করেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমসহ সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটবে।