কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীন সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবিতে দেশব্যাপী পদযাত্রা করেছে বিএনপি। একই দিনে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ‘উন্নয়ন শোভাযাত্রা ও শান্তি সমাবেশ’ করেছে আওয়ামী লীগ।
মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দেশের বিভিন্ন জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে এই দুই দলের কর্মসূচি পালন হলেও কয়েকটি জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ঢাকা :
রাজধানীর মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজের সামনে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে গাবতলী থেকে শুরু হওয়া এ পদযাত্রা মিরপুর হয়ে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড়ে যাওয়ার সময় বাঙলা কলেজ এলাকায় পৌঁছালে পেছনের অংশে বিশৃঙ্খলা বেঁধে যায়।
পদযাত্রায় থাকা শ্রমিক দলের কর্মী আবিদ আলী বলেন, “আমরা স্লোগান তুলে যাচ্ছি, সেই সময়ে কলেজের ভেতরে ঘাপটি মারা কিছু সরকারি দলের পাণ্ডা ইটপাটকেল মারে। আমরা ধাওয়া করার পর তারা পালিয়ে গেছে।”
বিএনপির নেতাকর্মীরা এ সময় কলেজের গেইট ভাঙচুর করে। রাস্তায় থাকা একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয় এ সময়। অল্প সময়ের এই মারামারির মধ্যেই পদযাত্রার সামনের অংশ এগিয়ে যায়।নেতাকর্মীদের লাঠিতে জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে মিছিল করে যেতে দেখা যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মো. জসিম উদ্দীন মোল্লা বলেন, “কলেজ খোলা ছিল আর মিছিল যাওয়ার সময় ঢিল ছোড়ার ঘটনা থেকে একটু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।”
মানিকগঞ্জ :
মানিকগঞ্জে জেলা বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশের বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুরে পদযাত্রা বের করলে জেলা শহরের বেউথা মোড় এলাকায় পুলিশ তা আটকে দেয়। পরে পথেই সমাবেশ করেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
সরেজমিন দেখা যায়, বেলা ১১টা থেকে জেলা শহরের বেউথা সেতুর দক্ষিণ পাশে জেলা বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সমবেত হতে থাকেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে সেখান থেকে পদযাত্রা বের করেন সহস্রাধিক নেতাকর্মী। এতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান (রিতা)। পদযাত্রায় নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দেন। পদযাত্রাটি সেতুর উত্তর পাশে বেউথা মোড় এলাকায় পৌঁছালে সেখানে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় নেতাকর্মীরা বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়। এরপর রাস্তায় বসে পড়েন নেতা-কর্মীরা। এ সময় সেখানেই সমাবেশ শুরু করেন তারা।
জেলা বিএনপির নেতা গোলাম কিবরিয়া সাঈদের সঞ্চালনায় সমাবেশে আফরোজা খান বলেন, “আজ দেশে কোনো নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। এ জন্য রাজপথে নেমেছেন হাজারো নেতাকর্মী। শান্তিপূর্ণ এই গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতেও পুলিশের বাধা। এই সরকারের অধীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।”
পদযাত্রায় বাধা দেওয়ার বিষয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রউফ সরকার বলেন, জনসাধারণের দুর্ভোগ এড়াতে বিএনপির নেতাকর্মীদের জেলা শহরে পদযাত্রা না করতে অনুরোধ করা হয়। পরে তারা বেউথা মোড় এলাকায় সমাবেশ করেন।
বগুড়া :
বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহরের ইয়াকুবিয়ার মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ সদস্যসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী ও পথচারী আহত হন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সকালে বগুড়ার বনানী থেকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনার নেতৃত্বে এই পদযাত্রা বের করা হয়। পদযাত্রাটি শহরের ইয়াকুবিয়ার মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদ বলেন, “বিএনপির নেতাকর্মীদের ইয়াকুবিয়ার মোড় থেকে সরাসরি সাতমাথায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তারা যেতে চাইলে আমরা এতে বাধা দিই। এ সময় তারা আমাদের ওপর লাঠি, ইট-পাটকেল নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে আমাদের অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পরে আমরা টিয়ারশেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিই।”
নোয়াখালী :
নোয়াখালী জেলা শহরে বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা।মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের সামনে ও শহরের বিশ্বনাথ এলাকায় বিএনপির এ পদযাত্রা কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, “জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে শহরের রশীদ কলোনী থেকে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে ৪-৫হাজার নেতাকর্মী রাস্তায় নামেন। এরপর পদযাত্রাটি শহরের বিশ্বনাথ এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে বাধা দেয়। তখন আমরা পুলিশের সঙ্গে বাড়াবাড়ি না করে পদযাত্রার পথ পরিবর্তন করে মাইজদী গার্লস একাডেমি সংলগ্ন মাইজদী-সোনাপুর সড়কে ঘণ্টাব্যাপী কর্মসূচি পালন করি।”
নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র হারুনুর রশীদ আজাদ বলেন, “শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আমরা সকাল ১০টার দিকে নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করি। পদযাত্রায় শুরুতেই পুলিশ বাধা দেয়। নেতাকর্মীরা পুলিশী বাধা অতিক্রম করে বড় মসজিদের সামনে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করে।”
বিএনপির নেতাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।”
রাজবাড়ী :
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজবাড়ীতে বিএনপির পদযাত্রায় দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা শহরের আজাদী ময়দান ও প্রেসক্লাবের সামনের প্রধান সড়কে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, পদযাত্রায় অংশ নিতে সকাল থেকে রাজবাড়ী বিএনপি কার্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা। কথা ছিল, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম গ্রুপ ও আসালাম-হারুন গ্রুপ এক হয়ে পদযাত্রায় অংশ নেবে। বিএনপির কার্যালয়ে প্রথম থেকেই আসলাম-হারুন গ্রুপের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। পরে খৈয়ম গ্রুপের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সেখানে এলে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খৈয়মের গ্রুপের আফছার আলী সরদার, যুবদল নেতা কাউন্সিলর সম্রাটসহ চার-পাঁচজন আহত হন।
খবর পেয়ে খৈয়ম গ্রুপের শত শত নেতাকর্মীরা বিএনপির কার্যালয়ে আসতে থাকেন। এ সময় পুনরায় খৈয়ম গ্রুপ ও আসলাম-হারুন গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আসলাম-হারুণ গ্রুপের নেতাকর্মীরা পিছু হটেন। খৈয়ম গ্রুপ বিএনপি কার্যালয় দখলে নেন। এসময় উভয়পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হন। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পিরোজপুর :
পিরোজপুরে জেলা বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দেওয়ায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ৯ পুলিশ সদস্য ও বিএনপির ১২ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে পিরোজপুর শহরের হুলারহাট সড়কের ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিএনপির ছয় নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুর ১২টার দিকে শহরের জেলা স্টেডিয়ামের সামনের সড়ক থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রাটি কিছু দূর যাওয়ার পর হুলারহাট সড়কের ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এ সময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিএনপির নেতাকর্মীরা সামনের দিকে যেতে চাইলে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে পিরোজপুর সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন, উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, মাকসুদুর রহমান, গোলাম সরোয়ারসহ পুলিশের নয়জন আহত হন। এ ছাড়া বিএনপির ১২ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
পিরোজপুর বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন বলেন, পুলিশ বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে লাঠিপেটা করেছে। এতে ১২ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তারা গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
পিরোজপুর সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিএনপির পদযাত্রা থেকে পুলিশের ওপর হঠাৎ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে পুলিশের নয়জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।