বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে এক দফা দাবিতে নানা নাটকীয়তা শেষে শুক্রবার (২৮ জুলাই) রাজধানীতে মহাসমাবেশের করবে বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলো আলাদা আলাদা করে করবে সমাবেশ। বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, একদফা দাবি আদায়ের আন্দোলনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসবে এই মহাসমাবেশ থেকে।
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর নেতাদের দাবি, ঢাকার ১১ স্থানে পৃথক কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে পুরো রাজধানীতে মহাসমাবেশের স্থান হিসেবে রূপ দেওয়ার চিন্তা করছে তারা।
এদিকে শুক্রবারের সমাবেশকে ঘিরে সরকারি দলের পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতির মাঠ সহিংসতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। তাদের দাবি, একদফা দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। ক্ষমতাশীল দল যদি সমাবেশকে ঘিরে যদি চক্রান্ত করে, কোনো ষড়যন্ত্র করে, সহিংসতা করে এই সমাবেশ নস্যাৎ করা যাবে না। বরং সহিংসতার দায় নিতে হবে তাদের।
বিএনপির মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “মহাসমাবেশ বিএনপির একার সমাবেশ নয়। এটা সারা দেশের মানুষের মুক্তির সমাবেশ। অতীতের সমাবেশ থেকে এটা ভিন্নতর মহাসমাবেশ হবে। কারণ এখান থেকে চলমান আন্দোলনের নতুন ঘোষণা আসবে।
তিনি আরও বলেন, “মহাসমাবেশকে সফল করার জন্য সারা দেশের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মীদের উপস্থিত নিশ্চিত করা। আমরা আহ্বান জানাতে চাই প্রশাসনের কাছে, আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার সব ব্যবস্থা আপনারা করবেন। অন্যথায়, সব দায়দায়িত্ব সরকারকে, কর্তৃপক্ষকে এবং যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের বহন করতে হবে। আমরা সরকারের কোনো পাতানো খেলায় পা দিতে চাই না।”
গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আন্দোলনে যে ঢেউ লেগেছে তাতে জনগণ আর পিছু পা হবে না। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা জনগণের সম্মতি নিয়ে আসেনি। বেআইনিভাবে আছে, অবৈধভাবে আছে। এই সরকার অবৈধ। আপনাদের আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে না। এ সমাবেশ থেকে চূড়ান্ত বার্তা দেওয়া হবে।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “লড়াইটা খুব পরিষ্কার। এই লড়াইয়ে শাসকরা ভয় দেখাতে চাচ্ছেন। শুক্রবার সব বিরোধী দল রাজপথে নামবে, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মহাজাগরণ হবে। ২৮ তারিখ হচ্ছে জনতার মুক্তির সমাবেশ। কাজেই সব ভয় উপেক্ষা করে রাজপথ দখলে নিন। জনতার রাজপথ জনতা দখল নিয়ে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা ঘটাবে। সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি আপনারা নিন।”
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। তার মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ মৎস্য ভবনের সামনে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি যৌথভাবে মতিঝিলে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি এফডিসি মোড়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ বিজয়নগর, ১২ দলীয় জোট বিজয়নগর পানির ট্যাংক, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পল্টনের আল-রাজী কমপ্লেক্সের সামনে, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য জাতীয় প্রেস ক্লাবে, বাংলাদেশ লেবার পার্টি পল্টনে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে এবং আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করবে।
এদিকে, নিজেদের পছন্দের জায়গায় সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) বিকেল ৪টার দিকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, “সম্মান প্রদর্শন করে বিএনপিকে নয়াপল্টনে এবং আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ২৩ শর্তে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
কেউ কোনো লাঠিসোঁটা ও ব্যাগ বহন করতে পারবেন না জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য দিতে পারবেন না। সীমানার বাইরেও যাওয়া যাবে না। এ ছাড়া কোনো বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে, ডিএমপির কমিশনারের পক্ষে বিশেষ সহকারী সৈয়দ মামুন মোস্তফা স্বাক্ষরিত ২৩ শর্ত দেওয়া হয়েছে দল দুটিকে। এর মধ্যে শর্তের চিঠি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদকে দেওয়া হয়েছে।
শর্তে বলা হয়, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ শর্ত যথাযথভাবে পালন সাপেক্ষে ২৮ জুলাই দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলো।
শর্তগুলো হলো-
১. এ অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
২. স্থান ব্যবহারের অনুমতিপত্রের উল্লেখিত শর্তাবলি যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
৩. অনুমোদিত স্থানেই মহাসমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৪. কোনো অবস্থাতেই অনুমোদিত স্থানের বাইরে কোনো ধরনের জনসমাগম করা যাবে না।
৫. নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে।
৬. স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী- নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মহাসমাবেশস্থলের চারদিকে উন্নত রেজ্যুলেশনযুক্ত সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৭. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মহাসমাবেশস্থলে আগতদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মহাসমাবেশস্থলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৯. শব্দদূষণ প্রতিরোধে সীমিত আকারে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, কোনোক্রমেই অনুমোদিত স্থানের বাইরে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
১০. অনুমোদিত স্থানের বাইরে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না।
১১. আজান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময়ে মাইক ব্যবহার করা যাবে না।
১২. ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে- এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
১৩. মহাসমাবেশের কার্যক্রম ছাড়া মঞ্চকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
১৪. মহাসমাবেশ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে লোকজন সমবেত হওয়ার জন্য আসতে পারবে।
১৫. অনুমোদিত সময়ের মধ্যে (দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা) মহাসমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
১৬. কোনো অবস্থাতেই মূল সড়কে যানবাহন চলাচল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
১৭. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়- এমন কার্যকলাপ করা যাবে না।
১৮. রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ বা বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
১৯. উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না।
২০. কোনো ধরনের লাঠিসোঁটা/ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে লাঠি, রড ব্যবহার করা যাবে না।
২১. আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও কোনো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
২২. উল্লেখিত শর্তাবলি পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এ অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।
২৩. জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া এ অনুমতির আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।