বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তাক্ত জুলাই হিসেবে স্থান করে নেওয়া ঘটনা শুধু সম্ভাবনাময় শত শত প্রাণই কেড়ে নেয়নি, দেশের অর্থনীতিকে অনিশ্চিত এক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। গোটা মাসজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করা, ইন্টারনেট ব্লকেজ আর সাধারণ ছুটির কারণে ব্যাংক বন্ধ থাকায় গ্রাহকরা সেই দিনগুলোতে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি বেশ কিছু ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে ঋণ বের করে নেওয়ার মতো নেতিবাচক খবরও প্রকাশিত হয় তখন। এতে ব্যাংক খাত নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
গেল জুলাইয়ে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব হলেও গ্রাহকরা ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে আমানত রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান তারা। চারদিকে গণ-আন্দোলনের জোয়ারের পরিণতি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সাধারণ মানুষ। ফলে ব্যাংক আমানতে ভাটা পড়ে। উল্টোদিকে মানুষের হাতে হাতে বেড়ে যায় নগদ টাকার পরিমাণ। ব্যাংক খাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমানত আর ফেরত আসার সম্ভাবনা দেখা যায়নি।
তবে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার গঠনের পর সব ধোঁয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। আস্থা ফিরতে শুরু করেছে শেয়ারবাজারসহ সার্বিক ব্যাংক খাতে। গেল আগস্ট আর চলতি সেপ্টেম্বরে আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করছে ব্যাংকের গতি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রক্তাক্ত জুলাই পেরিয়ে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি ভালোর দিকে যেতে শুরু করেছে। ব্যাংক খাতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে। এখন গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর দিকেই বেশি নজর দিতে বলেছেন ব্যাংকাররা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার মতো কিছু পজিটিভ সিগন্যাল দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ফিরে এসেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।”
গভর্নর আহসান মনসুর আশা করছেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ও অস্থিরতায় জুলাই মাসে ব্যাংকে আমানত ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায়। যা আগের মাসের চেয়ে দশমিক চার সাত শতাংশ কম। গত বছরের একই মাসের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তথ্যমতে, জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে বা মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। আগে মাস জুনের চেয়ে যা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের জুলাই মাস মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা।
আমানত কমে যাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন ব্যাংকাররা। এসব কারণের অন্যতম, পাঁচ দিনের ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, তিন দিন ব্যাংক বন্ধ থাকা ও দেশজুড়ে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রমে সাধারণ মন্দা নেমে আসা। অবশ্য, অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে হাতের কাছে নগদ অর্থ রাখতে চাওয়ায় আমানত কমার সঙ্গে সঙ্গে জুলাইয়ে মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণও বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোতে আমানত কমার কারণ হিসেবে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলছেন, “জুলাই মাসে আমাদের ব্যাংকে (ব্যাংক এশিয়ায়) আমানত বাড়লেও পুরো ব্যাংক খাতে বাড়েনি।”
এ ব্যাপারে পূবালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, “জুলাইয়ে আমানত তুলে নেওয়ার কারণে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তবে শক্তিশালী ব্যাংকগুলো ভালো আমানত পাচ্ছে।”
অন্যদিকে, আমানত ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতির মাত্রাও কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ের রেকর্ড ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে কমে আগস্টে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কমেছে ১ দশমিক ১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। এই প্রবণতাকে অর্থনীতিসহ ব্যাংকখাতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।