‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসা খাত ঘুরে দাঁড়াবে’ এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার(২৬ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কের ওয়েস্টিন নিউ ইয়র্ক গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে আয়োজিত বিজনেস রাউন্ডটেবিলে অংশ নিয়ে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্তি করেন।
এ সময় বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের অংশীদারত্ব কামনা করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, “আমি এখানে আপনাদের কথা শুনতে এসেছি এবং আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশ কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ চাই। আমাদের এই নতুন যাত্রায় আপনাদের অংশীদারত্ব চাই।”
এই রাউন্ডটেবিলের আয়োজন করে ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল (ইউএসবিবিসি)।
ড. ইউনূস বলেন, “প্রায় দুই মাস হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশ ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। আপনারা বেশির ভাগই নিশ্চিতভাবে প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। আমাদের যুবসমাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কারের দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।”
ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা প্রত্যেকেই ব্যবসায় বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে থাকবেন।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন একটি পরিবেশ তৈরির কাজ শুরু করেছে, যেখানে ব্যবসায়ের বিকাশ ঘটতে পারে এবং উদ্যোক্তারা সাফল্য লাভ করতে পারে। যে কোনো ব্যবসার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীলতা, পূর্বাভাস এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ।”
তিনি বলেন, “অতএব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের পরে আমাদের সরকারের মূল অগ্রাধিকার হলো ব্যাপক অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার করা। বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি শ্বেতপত্র প্রকাশে কাজ করছে। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ কমিটির কাজ শেষ হবে। এটি অর্থনীতির মানদণ্ড স্থাপন করবে এবং সংস্কারের সুপারিশ করবে।”
ড. ইউনূস বলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার কাজ হাতে নেওয়া কেন জটিল। দুর্নীতি ও পদ্ধতিগত অনিয়ম রাজস্ব ও আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট করেছে। এটি নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, অন্তর্দৃষ্টি পাওয়ার বিষয়।”
তিনি বলেন, “প্রায় এক মাসের মধ্যে আমরা রাজস্ব ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পেরেছি, টাকা স্থিতিশীল করতে পেরেছি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। এর পরিবর্তে, আমরা ঘাটতি অর্থায়নের জন্য মুদ্রাস্ফীতিহীন ব্যবস্থা ব্যবহার করছি।”
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প যেগুলো শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাস্তবায়ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে অবশিষ্ট কাজে ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ আছে কি না আমরা দেখছি। যেখানে সুযোগ আছে, আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিলের বিষয়টি বিবেচনা করছি।”
“রাজস্ব খাতের দুর্বলতা দূর করতে আমরা সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করছি। গত দুই দিনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইড প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেন এসব বিষয়ে অবগত হয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও আর্থিক নয় এমন সহায়তা চালু করার কথা উল্লেখ করেছেন,” যোগ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, “আমি জানি, আপনাদের কিছু কোম্পানি মুনাফা প্রত্যাবাসনে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি হিসাবে ঘাটতির মুখোমুখি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ থেকে অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ পাচারের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।”
ড. ইউনূস বলেন, “রিজার্ভ যাতে আবারও কমে না যায়, সেই জন্য আমাদের সরকার এই ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তার জন্য আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। ক্রলিং পেগ চালু করে মুদ্রা ব্যবস্থাকে আরও বাজারমুখী করে তোলা হয়েছে। মুদ্রা বাজারে ইতোমধ্যে স্থিতিশীলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।”
“ব্যাংক এবং এনবিএফআইগুলোর জবাবদিহিতা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঢেলে সাজাতে যোগ্য নেতৃত্ব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে একজন অভিজ্ঞ গভর্নর আছেন, যাকে মুদ্রানীতির স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং ব্যাংকিং খাতে অপরিবর্তনীয়ভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে,” বলেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “বেশ কয়েকটি রুগ্ন ব্যাংকের প্রেক্ষাপটে আমানতকারীদের আস্থা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানত ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স দ্বিগুণ করেছে, যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে হয়, ৯০ শতাংশ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেবে। গভর্নর ইতোমধ্যে এডিবির সহায়তায় ব্যাংকিং খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। ওইসব ব্যাংকের নন-পারফর্মিং ঋণ সম্পদের পৃথকীকরণের কাজ চলছে। মার্কিন ট্রেজারি আমাদের সমস্যাযুক্ত সম্পদ পুনর্বাসন প্রচেষ্টায় সমর্থন করার আশ্বাস দিয়েছে।”
বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক অংশীজনরা সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানোর জন্য আমরা একটি কমিশন গঠন করেছি। জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা না পেলে এ ধরনের প্রচেষ্টা টেকসই হবে না। তাই আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ এমনকি পুলিশেরও সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। এই পরিবর্তনগুলো সমর্থন করার জন্য দেশের সংবিধানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ব্যাপারেও আমরা কাজ শুরু করেছি।”
তিনি বলেন, “আমাদের অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের গল্পটি আসলে আমাদের জনগণের স্থিতিস্থাপকতার গল্প। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, দুর্নীতি অর্থনৈতিক সুযোগকে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ করা সত্ত্বেও আমাদের বেসরকারি খাত ভালো করছে। আমাদের শিল্পোদ্যোগগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামগ্রিক সংস্কার নিয়ে কাজ করছে, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি, কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে দেখবেন।”
যুব প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমাদের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় ২৭ মিলিয়ন, যা দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩৭ শতাংশ। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলে বা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসাগুলো পরিচালনা করলে ব্যবসা উপকৃত হতে পারে।”
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে এ সময় তিনি পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানান।
শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং শ্রমের মান উন্নত করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চিন্তায় শীর্ষে রয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশে আইএলও নির্ধারিত শ্রমমান অর্জনে আমরা আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি বলেন, “শ্রমমান উন্নয়নে আইএলও রোডম্যাপ বাস্তবায়নে আমরা আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া অনেককেই পিছিয়ে দিয়েছে। সুতরাং, আমাদের লক্ষ্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোর পরিবর্তে শিক্ষা ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগ করা।”
তিনি আরও বলেন, “বাণিজ্যিক ব্যবসার পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগের অপ্রচলিত সুযোগ তৈরি করতে হবে।”
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ শুধু ১৭ কোটি মানুষের বাজার নয়। এটি দ্রুত বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ভোক্তা বাজারের একটি হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনের ৩০০ কোটি মানুষের বাজার ধরার সম্ভাবনাময় জায়গায় রয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “কোনো দেশই সমস্যামুক্ত নয়। বাংলাদেশও সমস্যামুক্ত নয়। তবে আমি একটি বিকাশমান বাংলাদেশ দেখি, যে দেশটি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।”
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগী। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান রপ্তানির দেশ এবং আমাদের এফডিআইরও (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) শীর্ষ উৎস। কিন্তু বাণিজ্য অস্বাভাবিক রকমের কম।”