মে মাসের শুরুর পর থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে বঙ্গোপসাগরে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে থাকা গভীর নিম্নচাপটি উত্তর ও উত্তর–পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। কক্সবাজার এবং মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়।
মূলত এপ্রিল-মে মাসেই ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে বাংলাদেশে। বিশেষ করে মে মাসে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলা করেছে। মে মাস বাংলাদেশের জন্য দুর্যোগের মাস হয়ে উঠেছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার আগমন বার্তা শোনার পর থেকেই মে মাসের গত কয়েক বছরের ঘূর্ণিঝড়ের দাপটের স্মৃতি জেগে উঠে।
১৯৪১ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২২ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র মে মাসেই বাংলাদেশ মোট ১৮টি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। একের পর এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এসব ঘূর্ণিঝড়ে একসময় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারালেও বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করায় প্রাণহানির সংখ্যা একেবারে কমে গিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এসব তথ্য জানিয়েছে।
জেনে নিন মে মাসের ১৮টি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের যাবতীয় তথ্য:
১৯৪১ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তীব্র স্রোত মেঘনা নদীর পূর্ব মোহনায় আঘাত হেনেছিল। তবে এর ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানান যায়নি।
১৯৪৮ সালের ৭ থেকে ১৯ মে একটি ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী মধ্যবর্তী ব-দ্বীপে। আনুমানিক ১ হাজার ২০০ মানুষ এতে প্রাণ হারিয়েছিল এবং ২০ হাজার গবাদি পশুও মারা যায়।
১৯৫৮ সালের ১৬ থেকে ১৯ মে মেঘনা নদীর পূর্ব পশ্চিম মোহনার পূর্ব বরিশাল ও নোয়াখালী উপর আঘাত হানে শক্তিশালী একটি ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়ে প্রাণ হারান ৮৭০ জন। ১৪ হাজার ৫০০ গবাদি পশু মারা যায় এবং ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৬১ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান সেই ঝড়ে। ২৫ হাজার গবাদিপশুও প্রাণ হারায়।
১৯৬৩ সালের ২৮ থেকে ২৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত করে হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া এবং মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ। চট্টগ্রামে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ২ মিটার, বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৩ কিলোমিটার এবং কক্সবাজারে ঘণ্টায় ১৬৪ কিমি। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।
১৯৬৫ সালের ১১ থেকে ১২ মে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিমি এবং জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭ মিটার। ওই ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু হয় ১৯ হাজার ২৭৯ জনের।
১৯৭৫ সালের ৯ থেকে ১২ মে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ভোলা, কক্সবাজার ও খুলনাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৬.৫ - ১১২.৬ কিমি। ওই ঝড়ে মারা যান ৫ জন।
১৯৮৫ সালের ২৪ থেকে ২৫ মে উরিরচরের ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলীয় অঞ্চলে (সন্দ্বীপ হাতিয়া ও উড়ির চর) আঘাত হানে। চট্টগ্রামে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিমি, সন্দ্বীপে ১৪০ কিমি, কক্সবাজারে ১০০ কিমি এবং ঝড়ের কারণে জোয়ারের উচ্চতা ৩ থেকে ৪ দশমিক ৬ মিটার ছিল। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান উপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা। মারা যায় ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি গবাদিপশু। এছাড়া প্রায় ৯৫ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৭৪ কিমি রাস্তা ও বাঁধ বিধ্বস্ত হয়।
ঘূর্ণিঝড় নার্গিস উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি ঘূর্ণিঝড়, যা ২০০৮ সালের ৩ মে বার্মার উপকূলে আঘাত হানে।
২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
২০১৩ সালের ১৬ই মে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আঘাত হানে। তাতে প্রাণ হারান ১৭ জন।
২০১৬ সালের ২১শে মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস তৈরি করে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। সেই ঘূর্ণিঝড়ে লাখখানেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ২৪ জনের।
২০১৭ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোরা। ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে আঘাত হানে এটি।
২০১৯ সালের মে মাসে (২-৩ মে) ভারতের উড়িষ্যা উপকূলের দিকে আঘাত হানে। এর পরেরদিন, ফণী দুর্বল হয়ে ক্রান্তীয় ঝড় হিসেবে কলকাতা ও পরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ওই ঝড়ে প্রাণ হারান ৯ জন। ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এছাড়া ২০২০ সালের ২০শে মে সুপার সাইক্লোন আম্পান বাংলাদেশে আঘাত হানে। ২০২১ সালের ২৬শে মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানে এবং ২০২২ সালের মে মাসে আঘাত হানে আসানি। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও বাংলাদেশে সেই তুলনায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।