পানি ও নদী, বিষয়টি বর্তমানে ভূ-রাজনীতির অংশ, তাই বাংলাদেশকে এখন সেভাবে তৈরি হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর মো. শহীদুল হক।
রোববার (২৩ জুলাই) নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার ‘নদীবিষয়ক’ এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
শহীদুল হক বলেন, “ভূ-রাজনীতি ভালো বা মন্দ শব্দ নয়। এটি একটি খেলা এবং এটি সব দেশ খেলে থাকে। কেউ ভালো খেলে, কেউ খারাপ খেলে। এটি নির্ভর করে কে কত ভালো খেলোয়াড়। কূটনীতিকদের ভূ-রাজনীতিকে ভয় পেলে চলবে না। বরং এটিকে ব্যবহার করে দেশের জন্য মঙ্গলজনক সুবিধা আনতে হবে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে খুব মধুর সম্পর্ক থাকলেও নদী ও পানি সংক্রান্ত বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত জটিল বিষয়। একইসঙ্গে এটি একটি নিরাপত্তার বিষয়।”
গঙ্গা চুক্তি নবায়নের রসায়ন এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, “গঙ্গার পানি চুক্তির জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শুরু হবে। ১৯৯৬ সালে যেভাবে গঙ্গাচুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, সেভাবে এখন আলোচনা হবে না। এখন মানুষের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি থাকবে, যেটি ১৯৯৬ সালে ছিল না। ওই সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে এবং সবার অন্তরালে আলোচনা হয়েছিল। এবার তা হবে না।”
তিনি আরো বলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারত-বাংলাদেশ-বঙ্গোপসাগর করিডোর নিয়ে আলোচনা চলছে। এই ব্যবস্থা কার্যকরী করতে হলে দুটি জিনিস দরকার। প্রথমটি হচ্ছে অভিবাসন ও চলাচল (মাইগ্রেশন অ্যান্ড মোবিলিটি) এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে পানি। আমরা কি এই নিরবচ্ছিন্ন করিডোর তৈরি করতে পারব?”
সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলে থাকি, কিন্তু মন-মানসিকতায় আমরা ভূমিকেন্দ্রিক। যদি আমরা আমাদের অবকাঠামো দেখি, সেটি প্রায় সবকিছু ভূমিকেন্দ্রিক। কারণ যখন আমরা আন্তঃনদীর কথা বলি, তখন তা ভূ-রাজনীতির অংশ। যখন দুই দেশ আলোচনা করে, সেটি অবশ্যই রাজনীতি।”
বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা তুলে ধরে ইমতিয়াজ আহমেদ আরো বলেন, “পানি শুধুমাত্র অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন মিশ্রণ নয়। বর্তমানে এর সঙ্গে আরো চারটি বিষয় জড়িত– পাওয়ার, পলিটিক্স, প্রফিট এবং পলিউশন। ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে অর্থনৈতিক কারণে। বাংলাদেশ আগেও ছিল, কিন্তু তখন অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম ছিল। কিন্তু এখন সেটি বেড়েছে।
সেমিনারে অংশ নিয়ে অ্যাকশন এইডের বাংলাদেশ প্রধান ফারাহ কবির বলেন, “পানিকে আমরা সাধারণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু এখানে সাধারণ মানুষের অধিকার কম। আগে পানির প্রাচুর্য থাকলেও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। আগে যেভাবে বৃষ্টি হতো এখন আর সেভাবে হয় না।”
ভারতের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রতীপ চট্টোপ্যাধ্যায় বলেন, “পানিকে জাতীয় সম্পদ নয়, বরং প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। নদীর বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।”
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত ৩০ বছরের সামগ্রিক চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন করা হতে থাকে। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার পানির ভাগ পেতে থাকে।
আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ওই চুক্তি নবায়নের জন্য আলোচনা শুরু হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের আলোচনা আর আগের মতো হবে না। গঙ্গা চুক্তি নবায়নের বিষয়টি এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।